গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি


১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্যাসক্ষেত্র সমূহ ক্রয় করে এ দেশের জনগণের ব্যবহারের জন্য। গত ৭ই আগষ্ট ২০১৬ইং তারিখ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রকৃত ক্রয় মূল্য নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ এনার্জী রেগুলেটরী কমিশন (বিইআরসি) একটি গণশুনানীর আয়োজন করেছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণই মনে করে গ্যাসের এই মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক ও অবান্তর। গত বছর ১লা সেপ্টেমর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এক বছর যেতে না যেতেই কার স্বার্থে আবারো গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। গত ২৯ই মার্চ ২০১৬ আইওসি গ্যাসের প্রকৃত ক্রয়, উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানী সমূহের প্রকৃত রাজস্ব চাহিদা এবং ভবিষ্যতে উচ্চ মূল্যের এল.এন.জি ক্রয়ের মাধ্যমে জ্বালানী ঘাটতি মোকাবেলার জন্য সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক বিইআরসি ২৯ মার্চ গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যহার ও বিতরণ মার্জিন বৃদ্ধির আবেদন করে। এর প্রেক্ষিতেই বিইআরসি’র লোক দেখানো এ গণশুনানীর আয়োজন করেছে বলে আমরা মনে করি। আর এর ফলে জনমনে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্বেগ হয়েছে। যেমন,
    টিজিটিডিসিএল, তিতাস সহ জ্বালীন সেক্টরের সকল প্রতিষ্ঠানের বেতন ভাতাদিসহ সকল রাজস্ব চাহিদা পূরণ হয় ভোক্তাদের অর্থে, সরকারের অর্থে নয়। সংবিধান মতে তাই এর মালিক জনগণ, সরকার নয়।
    আইওসি গ্যাসের ক্রয়মূল্য পরিশোধের প্রক্রিয়া কিভাবে হবে এবং আমদানিকৃত এলপিজি’র মূল্য কত হবে? তা এই গণশুনানিতে উপেক্ষিত হয়েছে।
    গ্যাসের যে ঘাটতি রয়েছে তা কিভাবে পূরণ করা হবে? তার কোন দিকনির্দেশনা এই গণশুনানিতে নাই।
    আগামীতে এলএমজি বা উচ্চ মূল্যের জ্বালানী কখন এবং কি পরিমাণে জ্বালানী মিশ্রণে সম্পৃক্ত করা হবে? গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় বছর ভিত্তিক কি হারে বৃদ্ধি পাবে? তার কোন ব্যাখ্যা এই গণশুনানিতে নাই।
    ভোক্তাভেদে ৬২%-১৪০% মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব কি ন্যায় সংগত?
গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের তথা দেশের জনগণের উপর যে প্রভাব পড়বে তা হচ্ছেÑ
১.    বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাবে কিন্তু বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমলেও তার সুফল দেশের জনগণ পায় নাই। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব ৬৩%। বিশ্ব বাজারের সাথে তেলের দাম সমন্বয় করলে বিদ্যুতের দাম কমতো তা না হয়ে উল্টো সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো।
২.    সার উৎপাদনে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব ৭১%। জ্বালানী তেলের দরপতন ও তার সমন্বয় সুবিধা থেকে কৃষি বঞ্চিত হয়েছে। গত বছর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আবারো গ্যাস ও সিএনজি’র দাম বাড়লে কৃষি পন্যের উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে এবং পরিবহন সেক্টরে চাঁদার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এতে করে কৃষি ও কৃষক বিপন্ন হয়ে পড়বে।
৩.    আবাসন খাতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব ৮৪%। ফলে ডাবল চুলায় গ্যাসের দাম পড়বে ১১০০ টাকা। এর ফলে নি¤œ ও নি¤œ মধ্যবৃত্ত আয়ের এই বিশাল ব্যয় মেটানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়বে। আবাসিক খাতে ৯২ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করবেন বলে ধরে নিয়েই গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয় কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আবাসিক খাতের গ্রাহকগণ ৯২ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে না। তাই একে সিস্টেম লস না বলে সিস্টেম গেইন বলা হয়।
৪.    শিল্প ও বাণিজ্যে বৃদ্ধির প্রস্তাব যথাক্রমে ৬২% ও ৭২%। এখাতে অবৈধ ও অপরিকল্পিত গ্যাস সংযোগ এ উভয় গ্রাহককে ভয়াবহ জ্বালানী সংকটে রেখেছে। ফলে এখাতে দাম বৃদ্ধি পেলে প্রতিবেশী দেশের উৎপাদিত পণ্যের দামের চাইতে বেশি পড়বে এবং রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। বিনিয়োগ থমকে দাঁড়াবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারী প্রায় ৩০ হাজার শিল্পকারখানা বিপন্ন হয়ে পড়বে।

৫.    সিএনজি’র মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব ৮৩%। গতবারে বৃদ্ধি হয় ২৬%। জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি হয়নি তাতে সিএনজি চালিত পরিবহনের ভাড়া সরকার ১০% বাড়ালেও পরিবহন মালিকেরা বাড়ায় ৫০%। সাথে সাথে তেলে চলা পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে একই অনুপাতে তেলের দাম না বাড়লেও। আবার জ্বালানী তেলের দাম কমানো হলেও ভাড়া কমেনি। সিএনজি’র মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করার ক্ষেত্রে এ ভয়াবহ পরিস্থিতি বিবেচনায় না নেয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
গ্যাসের মূল্য না বাড়িয়েও কিভাবে উৎপাদন, বিতরণ, বিপনন ও ক্রয়ে সমন্বয় সাধন করা যায় এবং জনসাধারণকে ভোগান্তিতে না ফেলে এর সমাধান করা যায়। আমরা লক্ষ্য করি যে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আমদানিকৃত এলএমজিতে সরকার প্রায় ৪০০ টাকা ভর্তুকি প্রদান করছে। অথচ আমাদের নিজস্ব সম্পদ থাকতেও কেন আমাদেরকে উচ্চ মূল্যে এই গ্যাস ক্রয় করতে হবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কতিপয় সুপারিশ নি¤েœ তুলে ধরছি ঃ
১.    গণপরিবহন ও ব্যক্তি পরিবহনের জন্য আলাদা সিএনজি’র দাম নির্ধারণ করতে হবে।
২.    আবাসিক গ্যাস মিটারযুক্ত করতে হবে। তাতে করেও কিছু অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
৩.    আবাসিক এলাকাভেদে আবাসন খাতে গ্যাসের মূল্য আলাদা ভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৪.    বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ডমেস্টিক সংযোগ বন্ধ করতে হবে। এতে করে চুরি ও অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
৫.    গ্যাস কোম্পানীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর দাখিল করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে করে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব হবে।
৬.    গ্যাস বিক্রিতে ৫৫% শুল্ক ও ভ্যাট কমিয়ে আনতে হবে।
৭.    তিতাসের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা এফডিআর করা রয়েছে। এই বিপুল অংকের টাকার এফডিআর এর লভ্যাংশ কোথায় যায় তা জনগণের কাছে পরিস্কার করতে হবে।
৮.    আগামী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জ্বালানীর কি ব্যবস্থা করা হচ্ছে তার দিক নির্দেশনা থাকতে হবে।
৯.    তিতাসের ২৫% মালিকা শেয়ার হোল্ডারগণ। শেয়ার বাজার ধ্বসের ফলে এই ২৫% শেয়ার হোল্ডারকারী যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা এই গণশুনানীতে উপেক্ষিত হয়েছে।
অর্থাৎ দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করলে এ জ্বালানী খাতের মূল্যবৃদ্ধি না করেও ব্যাপক উন্নতি সাধন করা সম্ভব। তাই আমরা আশা করি দেশের জনগনের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় রেখে সরকার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করবে। গ্যাসের এই মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব জনগণের মতামত জানার নিমিত্তেই আমাদের আজকের এই গণ স্বাক্ষর কর্মসূচির যাত্রা।

গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ।

উপস্থিত ছিলেন, সিপিবি’র কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবি এ্যাড. ইয়ারুল ইসলাম, প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ঈমাম ফিরোজ, প্রকৌশলী মোঃ সাইফুল্লাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি রুস্তম আলী, দুর্নীতি প্রতিরোধ আন্দোলনের সভাপতি হারুন অর রশীদ খান, নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, আওয়ামী ন্যাপ ভাসানীর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইব্রাহীম, সংগঠনের মহাসচিব এ্যাড. আবু বকর ছিদ্দিকসহ সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
এছাড়াও আরো অনেক বিশিষ্ট নাগরিকগণ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করবেন।