‘তোমরা কি বোমা বানাও?’

‘তোমরা কি বোমা বানাও?’

‘তোমরা কি বোমা বানাও?’

অনিক আহমেদ

সম্প্রতি সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান অ‌্যান্ড প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের শেষ বর্ষের ৬ জন শিক্ষার্থী অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত রোবট উদ্ভাবন করেছেন।

প্রায় আড়াই মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি রোবটটির নাম দেয়া হয়েছে মিরা (MIRAA- Mobile & Intelligent Robot for Advanced Assistance)। মানুষের সাথে কথা বলা, বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর দেয়া, ভার্চুয়াল কাজে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে এতে। রাইজিংবিডি ডটকমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রোবট তৈরির গল্প শুনিয়েছেন মোহাম্মদ রিফাত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিক আহমেদ

রাইজিংবিডি: মিরা তৈরির কাজ কখন, কীভাবে শুরু করেন?

মোহাম্মদ রিফাত: এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু তৈরির ব্যাপারটা আমার মাঝে অনেক আগে থেকেই ছিল। ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে প্রতি বছর একাডেমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে ব্যতিক্রমী একটা প্রজেক্টে কাজ করবো। আর অ‌্যাডভান্সড টেকনোলজি নিয়ে পড়াশুনা করার বিষয়ে আমার আর্টিফিশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, নিউরাল নেটওয়্যার্ক নিয়ে আগ্রহ ছিল। তবে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু উজ্জ্বল সরকারকে (ইলেকট্রিক্যাল অ‌্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বড় ভাই) দেখে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে আগ্রহ শুরু হয়। তখন থেকেই রোবট তৈরির বিষয়টি মাথায় ছিল।

এরপর আমি দল গঠন করে ২০ জুলাই (২০১৯) কাজ শুরু করি। রোবট তৈরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি দুজনের অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করবো- উজ্জ্বল সরকার এবং মাসুদ রানা। শুরু থেকে তারা ল্যাব ফ্যাসিলিটিসহ বিভিন্ন সময় আইডিয়া শেয়ার এবং শারীরিকভাবে সাহায্য করেছে। আমাদের কাজের প্রায় আড়াই মাস পুরোটা সময় তাদের ল্যাবেই করেছি।

রাইজিংবিডি: রোবটটির উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলুন।

রিফাত: রোবটটির প্রধান ফিচার হচ্ছে- এটি পোর্টেবল এবং অটোমেটেড অর্থাৎ বাইরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পূর্ণ কাজ করতে সক্ষম। সফটওয়্যার চালুর পর নিজে নিজেই সব কাজ করতে পারে। রোবটের আর্টিফিশ্যাল ইন্টেলিজেন্স এবং মেশিন লার্নিং ক্যাপাবিলিটি তাকে বাইরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করার সক্ষমতা দিয়েছে। তাছাড়া আমরা প্রতিনিয়তই আমাদের রোবটের আপডেটের কাজ করছি। তাই এর সাথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দক্ষতা যুক্ত হচ্ছে।

বর্তমানে রোবটটি মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ভার্চুয়াল এবং শারীরিক কাজে সক্ষম। ভার্চুয়াল কাজের মধ্যে ইমেইল পাঠানো, পছন্দের গান বাজানো, নির্দিষ্ট কাজের কথা মনে করিয়ে দেয়া, সময় ও তারিখ জানানো, ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করা, আগাম পূর্বাভাস দেয়া ইত্যাদি কাজ করতে পারে। শারীরিক কাজের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি যেমন হ্যান্ডশেক বা হাই ফাইভ করা, কাজের সময় কফির কাপ ধরে রাখা, জোকস শোনানো, রক পেপার সিজার খেলা ইত্যাদি কাজে সক্ষম। এছাড়া রোবটটি যাদের সাথে কথা বলবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য মনে রাখতে পারবে এবং ঐ তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তীতে কথোপকথন করতে পারবে।

রাইজিংবিডি: রোবট তৈরির খরচের বিষয়টি যদি বলেন..

রিফাত: ইলেক্ট্রনিক্স এবং হার্ডওয়্যারের কাজের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে অনেক টাকার দরকার হয়। আমি চেয়েছিলাম তারাই কেবলমাত্র এই প্রজেক্টে ব্যয় বহন করবে, যারা সরাসরি প্রজেক্টে যুক্ত থাকবে। এরপর এই কাজের জন্য যোগ্য কিছু মানুষকে আমার ভাবনার কথা বলি এবং ৬ জনের দল গঠন করি। রোবটটি তৈরিতে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪৭ হাজার টাকা। পুরো খরচটা ৬ জনে সমানভাবে ভাগ করে দেই। আর যেহেতু পরিকল্পনা আগেই ছিল, তাই সবার অংশটা জমা করতে তেমন সমস্যা হয়নি। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, পুরো খরচ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স কম্পোনেন্ট আর রিসার্চের কাজে ব্যয় হয়েছে আর আমাদের রোবটের প্রোসেসিং ইউনিট হিসেবে আমার বন্ধুর (মারুফ- টিমমেট) ল্যাপটপকে ব্যবহার করেছি। তাই এই খরচটা প্রোসেসিং ইউনিটের খরচ বাদে বলা হয়েছে। আমার অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছেন- মাহতাবুর রহমান সবুজ, মারুফ হোসেন, মাহমুদা আক্তার নিঝুম, সাফিক হাসান, শারমিন নাহার তোহফা। সবাই সিএসই বিভাগের ২০ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

রাইজিংবিডি: মিরা তৈরিতে কোন ধরনের কোড ব্যবহার করা হয়েছে?

রিফাত: আমাদের প্রজেক্টের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রোবটটাকে পরিপূর্ণ অ‌্যাডভান্সড সিস্টেমের আওতায় আনা। এজন্য বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং কোড ব্যবহার করতে হয়েছে। যেমন আমরা যে ফ্রেমওয়ার্কের ওপর আমাদের রোবট তৈরি করেছি, তা লেখা হয়েছে জাভা কোডে। রোবটের স্ক্রিপ্ট অর্থাৎ যেটা রোবটকে চালানোর বিভিন্ন ইন্সট্রাকশন দেয় তা লেখা হয়েছে পাইথন কোড দিয়ে, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোসেসিংয়ে আমরা ব্যবহার করেছি এআইএমএল (AIML- Artificial Intelligence Markup Language) কোড এবং হার্ডওয়্যার কনফিগারেশনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ডট কনফ (কনফিগারেশন) কোড। ভার্সন ১.০ তে আমাদের রোবটের সর্বমোট কোডের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১১-১২ হাজার। কিন্তু সর্বশেষ সংস্করণে আমরা মিরার নলেজবেজে উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন অফলাইন ডেটাবেজ যুক্ত করেছি। এ কারণে আমাদের রোবট কোনোরকম ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে। ডেটাবেইজের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ মিলিয়ন লাইন।

রাইজিংবিডি: কি কি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে?

রিফাত: রোবটটি তৈরিতে আমরা বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। তবে সেগুলোর সমাধানও করতে পেরেছি। প্রধান সমস্যা হয়েছিল রোবটের বিভিন্ন ইন্টারনাল বিষয় যেমন রোবটের ব্রেইন (অর্থাৎ যেখানে সব ধরনের ডাটা প্রসেসিং হবে), বডি এবং পার্টস বানানোর উপাদান নিয়ে। আমরা অনেক সময় বৃষ্টিতে ভিজে, রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘোরাঘুরি করে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করেছি। রোবট তৈরির কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিককে তরলে রুপান্তর করতেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আরেকটা বিষয় ছিল, যখন গ্যারেজে কিংবা হার্ডওয়্যারের দোকানে গিয়ে কোনো জিনিস কিনতে চাইতাম, তখন প্রায় সময়ই আমাদের বলতো পিস্তল বানাব কিনা? রোবট বানাব বললে সহজে বিশ্বাস করতো না। তাছাড়া বাড়িওয়ালা প্রায়ই এসে বলতেন, তোমরা কি বোমা বানাও নাকি! যেহেতু আমরা একেবারে শুরু থেকে পুরো সিস্টেমের কাজ করেছি তাই প্রতি পদে পদে আমাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কখনো হার্ডওয়্যার কখনো সফটওয়্যার নিয়ে, কিন্তু সবার প্রচেষ্টায় সব সমস্যাকে জয় করতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: শুরুর দিকে আত্মবিশ্বাস কেমন ছিল?

রিফাত: সত্যি বলতে শুরু থেকেই আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি ছিল। আমি আমার গ্রুপের সবাইকে আগেই বলে দিয়েছিলাম, আমরা আমাদের প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে পারবো। আর না পারলেও হারানোর কিই-বা আছে, অন্তত কিছু তো অর্জন করতে পারবো। গ্রুপের সবার মাঝে সমানভাবে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখাটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। মাঝে মাঝে কোনো একটা সমস্যায় পড়লে সবার মন সতেজ রাখা, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখাটা বেশ কঠিন ছিল। আমরা একটা কৌশল অবলম্বন করেছিলাম।

রাইজিংবিডি: টিমের ভবিষ্য পরিকল্পনা কী?

রিফাত: মিরার ভবিষ্যতে বাংলা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোসেসিং যুক্ত করতে চাই। এছাড়া আমদের ফুল বডি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মতো আচরণ, মুভমেন্ট এবং অঙ্গভঙ্গি নিশ্চিত করা। ফলে মিরার সাথে যারা কথা বলবে তারা মনে করবে মানুষের সাথেই কথা বলছে, কোনো মেশিনের সাথে নয়। তাছাড়া মিরার প্রোগ্রাম্যাবল ভয়েস আরো ইম্প্রুভ করবো যাতে সে বিভিন্ন পিচে কথা বলতে পারে। এতে ব্যবহারকারী মিরার সাথে কথা বলে সন্তুষ্ট হবে। এছাড়াও এতে টেলিপ্রেজেন্স ক্যাপাবিলিটি যুক্ত করতে চাই, যা মিরার ভেতরে ভার্চুয়ালি কেউ প্রবেশ করতে পারবে। মিরার চোখ দিয়ে দেখতে পারবে এবং মিরার হাত পা দিয়ে কাজ করতে পারবে।

রাইজিংবিডি: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রিফাত: রাইজিংবিডি ডটকমকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাচ্ছি।



ঢাকা/অনিক/সাইফ



from Risingbd Bangla News https://ift.tt/39q8n0L