জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের সুনাম সমুন্নত রাখতে সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের সুনাম সমুন্নত রাখতে সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

টাঙ্গাইলদর্পণডটকম ডেক্স :  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের সুনাম সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তাঁর সরকার এক্ষেত্রে কোন রকম অনাকাঙ্খিত কর্মকান্ড বরদাশত করবে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম ক্ষুন্ন হয় এমন কোন অনাকাঙ্খিত কর্মকান্ড আমরা বরদাশত করবো না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম অক্ষুন্ন থাকবে। যে যেখানেই নিয়োজিত থাকুন না কেন নিজেদের দায়িত্ব মর্যাদার সঙ্গে পালন করবেন।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ (ডিএসসিএসসি) ২০১৫-’১৬ কোর্সের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। মিরপুর সেনানিবাসের শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে এই অনুষ্ঠানে তিনি গ্রাজুয়েটদের মাঝে সনদ বিতরণ করেন।

ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের কমান্ডডেন্ট মেজর জেনারেল সাজ্জাদুল হক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

মন্ত্রীবর্গ, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, তিন বাহিনীর প্রধানগন, সংসদ সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিক, জ্যেষ্ঠ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত সদস্যদের সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কোনভাবেই সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেয়া হবে না।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতা শুধু দেশেই নয়, বহির্বিশ্বেও অনেক সুনাম কুড়িয়েছে, যা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জল করছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের শান্তিরক্ষীরা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষার পাশাপাশি কর্মরত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের বিকাশ, আর্থ-সামাজিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে ব্যাপক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান-কি মুন’র উদ্বৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের প্রশংসা করে বলেছেন, এই কার্যক্রমে বাংলাদেশ নেতৃত্বের স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ।

তিনি বলেন, বিশ্বে মোট শান্তিরক্ষীর ১০ জনের ১ জন বাংলাদেশের। ১৯৮৮ সালে এ মিশন শুরুর প্রথম বছর ‘পর্যবেক্ষক’ থেকে পরবর্তীতে পরিচালিত মোট ৬৬টি মিশনের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৫টিতে অংশ নেয়। বর্তমানে পরিচালিত ১৬টি মিশনের ১১টিতে বাংলাদেশের ৮ হাজার ৫০১ শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন ।

সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের জাতীয় সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাহিনী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ক্ষমতা কাঠামোর অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান।

জাতির পিতা এই উপলব্ধি থেকে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সুশৃঙ্খল ও পেশাদার একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় ।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই স্টাফ কলেজে সেনাবাহিনীর ৪০টি , নৌ বাহিনীর ৩৪টি এবং বিমান বাহিনীর ৩৬টি কোর্স সম্পন্ন হয়েছে। বন্ধুপ্রতীম ৩৮টি দেশের ৯২৭ জন অফিসার এ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন।

স্টাফ কলেজটি আন্তর্জাতিক পরিম-লে সামরিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অনন্য এক প্রতিষ্ঠানের সুনাম অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী কলেজের কমান্ড্যান্ট, অনুষদ সদস্য এবং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।

সামরিক বাহিনীর কমান্ড ও স্টাফ কলেজের অবকাঠামোগত সুবিধা সম্প্রসারণে সরকার ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্টাফ কলেজের বহুতল একাডেমিক ভবনসহ আরও কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নির্মিত হয়েছে, যা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে।

এ বছর মোট ১১ জন মহিলা অফিসার এই কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন,‘ প্রতিবছর মহিলা অফিসারদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সশস্ত্র বাহিনীতে নারীদের অংশ গ্রহণ বর্তমান সরকারের ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ নীতির সাফল্যের আরেকটি স্বাক্ষর।’

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নারী সৈনিকদের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তাঁর সরকারই প্রথম বারের মতো সেনাবাহিনী এবং পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়।’

গ্রাজুয়েট অফিসারদের সহধর্মিনীগণ প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিভিন্ন গঠনমূলক সামাজিক কর্মকা-ে অংশ নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রশংসা করে বলেন,‘পি এস সি’ ডিগ্রি অর্জনকারীদের স্ত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং উৎসাহের ফলশ্রুতিতে আজ গর্বিত মিরপুরিয়ান।’

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় দেশের বিভিন্ন দুর্যোগে সেনা সদস্যদের সাহসিকতাপূর্ণ ভ’মিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার মহান দায়িত্ব পালনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি দেশপ্রেমিক এই বাহিনী সিডর ও আইলার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিসংযোগ ও রানা প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।’

দেশে বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মায়ানমারের সঙ্গে আইনী লড়াইয়ে আমরা সমুদ্রসীমা বিজয় অর্জন করেছি। ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে ছিটমহল বিনিময় ও স্থল সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ চলছে।

তিনি বলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জনের পর তাঁর সরকার এখন জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। বাজেটের শতকরা ৯০ ভাগ উন্নযন প্রকল্পে ব্যবহ্যত হচ্ছে। জীবন মানের পরিবর্তনের ফলে ৫ কোটি মানুষ নি¤œ আয় থেকে মধ্যবিত্তে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এ বছর বিনামূল্যে ৩৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৬২ হাজার ৭৭২টি পাঠ্যপুস্তুক বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লক্ষ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ (২০০৭ সাল) থেকে বর্তমানে ২০.৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭১শতাংশ ।

বিএনপি -জামাতের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন ৯৬ মেয়াদের সরকার দেশে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশে রেখে যাওয়ার পরও বিএনপি-জামাত সরকার ৫ বছরে এই হার বাড়ানোর পরিবের্তে উল্টো ৪৫ শতাংশে নামিয়ে আনে এবং খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশকে আবারও খাদ্য ঘাটতিতে নিয়ে যায়।

দেশে বর্তমান মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলারের কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন,‘ আওয়ামী লীগই অতীতের সকল আন্দোলন, সংগ্রামে বিজয় ও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের কা-ারী ছিল এবং আগামীতেও আওয়ামী লীগই অর্থনৈতিক মুক্তির দিশারী।’

প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার সংগ্রামে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানান।

শেখ হাসিনা বক্তৃতার শুরুতেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে জীবন দানকারী বাংলাদেশের ১২৮ বীর সৈনিককে স্মরণ করেন। তিনি স্বজন হারানো পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

২০১৫-১৬ বর্ষে ডিএসসিএসসি থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫৮ জন, নৌবাহিনীর ২৩ জন এবং বিমান বাহিনীর ২০ জনসহ মোট ৬৮ জন কর্মকর্তা গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।

এছাড়া, ব্রাজিল, চীন, মিশর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত, লাইবেরিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, নাইজেরিয়া,পাকিস্তান, ফিলিস্তীন, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, সিয়েরালিওন, শ্রিলংকা, সুদান, তানজানিয়া, তুরস্ক, উগান্ডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাম্বিয়ার ৬৭ জন কর্মকর্তা এ বছর এই কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।

তথ্যসূত্র : বাসস।