ভাঙনে নিঃস্ব ৫০ হাজার পরিবারের মানবেতর দিন কাটছে

ভাঙনে নিঃস্ব ৫০ হাজার পরিবারের মানবেতর দিন কাটছে

ভাঙনে নিঃস্ব ৫০ হাজার পরিবারের মানবেতর দিন কাটছে

বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে গত ত্রিশ বছরে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে লক্ষীপুরের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় আশ্রয় নিয়েছেন বিধবস্ত বেড়ী বাঁধ আর বিভিন্ন সড়কের দু’পাশে। স্ত্রী, সন্তান ও গবাদি পশু নিয়ে এ সব মানুষ খোলা আকাশের নিচে অথবা টিনের ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের অনেকে এখন মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এদিকে, জেলা প্রশাসক বলছেন- নদী ভাঙ্গাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঘর দেয়া হচ্ছে। জেলায় কোন গৃহহীন থাকবেনা বলে আশ্বাস দেন তিনি।

স্থানীয়রা জানায়, এ জেলায় মেঘনার অব্যাহত ভাঙ্গণ তান্ডব প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চলে আসছে। বর্ষায় ভাঙ্গণের তীব্রতা বাড়ে। শুধু রামগতি-কমলনগর এলাকাই নয়, এ ভাঙ্গণের প্রভাব পড়েছে জেলা সদর, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী এলাকায়। বিশেষ করে ভাঙ্গণের তীব্রতা ছিল রামগতি ও কমলনগরে ব্যাপক। এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বহু মানুষের ভিটে বাড়ি ও ফসলি জমি। সর্বস্ব হারিয়ে এখানকার মানুষ বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। বিত্তবানরা বিভিন্ন জেলায় চলে গেলেও বেশীর ভাগ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে বেড়ী বাঁধসহ বিভিন্ন সড়কের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে নদীভাঙ্গা এমন পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজারে। বিশেষ করে সদরের মজু চৌধুরীর হাট থেকে মতিরহাট পর্যন্ত সরকারি বেড়ী বাঁধের দু’পাশে, রামগতি সড়কের মিয়ার বেড়ী থেকে তোরাবগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে, তোরাবগঞ্জ থেকে মতির হাট সড়কের বিস্তীর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এসব মানুষ কেউ কেউ কাটাচাটা টিন, প্লাস্টিকের পলিথিন আর হোগলা পাতার ছাউনিতে জরাজীর্ন লক্কর ঝক্কর ঘর তৈরি করে বাস করছেন। খোলা আকাশের নিচেও বাস করছেন কেউ কেউ।

তবে নদীকূল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার মানুষ জীবন জীবিকা নির্বাহে সবাই কর্ম ব্যাস্ত। এদের কেউ বুনছেন জাল, কেউবা পালন করছেন পশু-পাখি, কেউবা ধরছেন মাছ, আবার কৃষিসহ হাতের কাজে উপার্জন করছেন অনেকে। সবাই জীবন সংগ্রামে লড়লেও এদের বাসস্থানে এসে হতাশা ও দুর্ভোগে মানবেতর জীবন যাপনের চিত্র ভেসে উঠে। 

নদী ভাঙ্গা এমন এক পরিবারের সন্ধান মিলে সদরের মজু চৌধুরীর হাট বেড়ী বাঁধ এলাকায়। তারা ৩০ বছর ধরে বাস করছেন এ এলাকায়। নুরু মেস্ত্রী ও তার স্ত্রী সাজু বেগম দু’জনই এখন বয়োবৃদ্ধ। তবুও থেমে নেই এ দম্পত্বির পথ চলা। 

জানতে চাইলে নুর মেস্ত্রী নদী ভাঙ্গার কথা শুনিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, এক সময় সবই ছিল তার কিন্তু এখন তিনি সর্বহারা। বসবাসের জন্য সুন্দর একটি স্থান চান তিনি। তবে অর্থের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই সরকারের কাছে একটি ঘর পাওয়ার আক্ষেপ তার। 

একই কথা তার স্ত্রীরও তিনি বলেন, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দূর্ভোগে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। জাল বুণে যে টাকা রোজগার হয় তা দিয়ে খেয়ে পরে সংসার চালানো এখন দায়। কিভাবে আর ঘর হবে। 

এমন পরিবারেরর সংখ্যা কম নয় আশে পাশের নয়ন বেগম, ফয়েজের নেছা, মরিয়ম বেগমসহ তাদের মতো অসংখ্য পরিবার নদী ভাঙ্গার শিকার হয়ে এখন বেড়ীর পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের সবার ঘরের একই অবস্থা। খোলা আকাশের নিচেও থাকছেন কেউ কেউ। এখন তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন, নিঃস্ব ও আশ্রীত বলেও জানান।

তারা বলছেন, গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছে সরকার, কিন্তু তারা তো পাচ্ছেনা। মাথা গুছাবার ঠাই হিসেবে সরকারি বরাদ্ধের ঘর প্রাপ্তির দাবি জানান সকলে।

এদিকে যে বেড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন সেটিও এখন বিধ্বস্ত। এতে করে দূর্যোগ ও জলোচ্ছাসের শঙ্কায় উৎকন্ঠা আরো বেড়েছে নদীভাঙ্গা এসব মানুষসহ নদীতীরবর্তী বাসিন্দাদের। যদিও সরকার সম্প্রতি নদী তীর রক্ষা বাঁধের জন্য ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলে নদী ভাঙ্গা সমস্যা থাকবেনা। দুর্ভোগও কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে সচেতন মহল মনে করছেন এদের পূণর্বাসনের মাধ্যমে এ বিশাল জনশক্তি বাস্তব কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব।

জানতে চাইলে জেলা এনজিও ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, এসব বিশাল জনগোষ্ঠি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বরাদ্ধের অপ্রতুলতা রয়েছে। দীর্ঘ বছরের নদী ভাঙ্গা পরিবারের সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ হাজার। সরকারি-বেসরকারিভাবে ঘর বরাদ্ধ আসে দুই হাজার পরিবারের। এতে করে হতাশ হচ্ছেন অনেকে। তবে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব বলে মনে করছেন এনজিও ফোরামের এ নেতা। 

জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ জানান, সম্প্রতি নদী তীর রক্ষা বাঁধের জন্য সরকার ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলে নদী ভাঙ্গা রোধ সমস্যা থাকবেনা। এছাড়া মুজিবশত বর্ষে ১৭৭৬টি ঘর বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। এর বেশীর ভাগ ঘর পেয়েছেন নদী ভাঙ্গা পরিবার। তবে আরো ৩ হাজার ঘরের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবেনা বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এএম

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/bangladesh/176280/ভাঙনে-নিঃস্ব-৫০-হাজার-পরিবারের-মানবেতর-দিন-কাটছে