দেখে লেখার অপরাধ এবং নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি

দেখে লেখার অপরাধ এবং নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি

সিরাজুল ইসলাম : লেখক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক


নকল করার দায়ে কি শাস্তি হয়েছিল দুই বন্ধুর!

আমি তখন ক্লাস সেভেন অথবা এইটে পড়ি। তখন মাধ্যমিক স্কুলে বছরে তিনটা পরীক্ষা হতো। সে কারণে ঘটনার সময়কালের পরীক্ষাটাকে মিড টার্ম বলা যায়। অর্থাৎ বছরের প্রথম পরীক্ষা এবং ফাইনাল পরীক্ষার মাঝে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। তো, সেবারও যথারীতি এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একদিন ক্লাসের দুই বন্ধু দেখাদেখি করে লিখছে। অর্থাৎ একজনের খাতা আর একজন দেখে লিখছে। এটা অত্যন্ত গোপনে করতে হচ্ছে তাদেরকে। তারপরেও সদা সতর্ক গোলাম রহমান স্যারের চোখে ধরা পড়ে গেল দুই বন্ধুর সেই দেখে লেখার বিষয়টি। যমের মত ছুটে গিয়ে গোলাম স্যার দুজনের খাতা কেড়ে নিলেন এবং দুজনকে তাদের আসন থেকে বের করে আনলেন।

গোলাম রহমান স্যার ছিলেন স্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক। এইট পর্যন্ত বিভিন্ন সাবজেক্টের ক্লাস নিতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত রসিক মানুষ। এমন সুন্দর বাচনভঙ্গি এবং মুখভঙ্গি করে গল্প বলতে পারতেন যা শুনে আমরা হাসিতে ফেটে পড়তাম। স্যারের ক্লাস ছিল আমাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। তিনি ছিলেন স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীর কাছে প্রিয় গোলাম স্যার।

সেই গোলাম সার আজ রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছেন। সঙ্গত কারণে বন্ধু দুজনের নাম উল্লেখ করছি না, শুধুমাত্র ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি। সেই দুই বন্ধুকে আসন থেকে বের করে গোলাম স্যার পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করালেন। তারপরে একে অপরের কান ধরালেন। সেখানে দুজন দুজনার কান ধরা অবস্থায় তাদের উঠবস করালেন। এটা ছিল অনেক বড় মাপের শাস্তি। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, আরো আছে

উঠবস করানোর পর কান ধরা অবস্থায় তাদের দুজনকে পুরো স্কুল ঘোরালেন গোলাম স্যার। নিয়ে গেলেন প্রত্যেকটি কক্ষে। এবং অভিযুক্ত দুই ছাত্র প্রত্যেক রুমে রুমে গিয়ে বলছে, "আমরা নকল করেছি তাই এই শাস্তি।" পেছনে রয়েছেন গোলাম স্যার। তার হাতে একটি কালো রঙের বড় শরীফ ছাতা। তখন ছিল বৃষ্টি-বাদলার দিন। ভেজা ছাতা। মাঝে মাঝে সেই ছাতা দিয়ে দুই ছাত্রকে পেটাচ্ছেন আর বলছেন, " সামনে আগা। আর নকল করবি? অপদার্থগুলো! স্কুলটা জ্বালিয়ে খেলো। লেখা নেই, পড়া নেই শুধু ফোর টুয়েন্টি!"

আমরা তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের শিক্ষার্থী। ঘটনা দেখে খুবই হাসি পেল। বন্ধুদের জন্য দুঃখও হলো। মনে মনে বললাম- তারা যদি ঠিকমতো লেখাপড়া করতো তাহলে আজকে দেখে লিখতে হতো না।

এই ঘটনা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, আজকাল বাংলাদেশে বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে যে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে সেখানে পরীক্ষার নামে... দেখে লেখার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আমার দুই ভাইঝি ক্লাস সিক্স এবং সেভেনের ছাত্রী। তাদেরকে আমি যতবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া করার কথা বলি ততবারই তারা বলে, "চাচু এত লেখাপড়া করে কি হবে? পরীক্ষা তো হবে দেখে লেখার মাধ্যমে। দেখে ঠিক মতো লিখতে পারলেই হলো। মুখস্ত করার কোন ব্যাপার নেই। সে ক্ষেত্রে এত টেনশনের কি দরকার?"

আমি লা জওয়াব হয়ে যায়। গত ফাইনাল পরীক্ষায় বড় ভাইঝিটি জানিয়েছিল শুধু বই দেখে লিখতে হয় না বরং গ্রুপভিত্তিক বই দেখে লিখতে হয়। অর্থাৎ একেক গ্রুপে পাঁচ ছয় জন থাকে তারা সবাই একসাথে বই দেখে লিখে "পরীক্ষা" দেয়।

আমরা জানি পরীক্ষা দেয়ার অর্থ হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রী কি শিখেছে তা তাদের মত করে উপস্থাপন করবে। তাতে কেউ অনেক বেশি ভালো পারবে, কেউ কম পারবে, কেউবা তার চেয়ে আরেকটু কম পারবে। যারা কম পারবে তাদের ঘাটতি কোথায়, কেন পারল না-এসব মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা এবং তাদের উন্নয়নে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেবেন।

কিন্তু এখন যেহেতু বই দেখে লেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে সে কারণে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা কোথায়, ঘাটতি কোথায় তা শিক্ষকরা কিভাবে বুঝবেন? তাদের মূল্যায়ন করা কিভাবে সম্ভব হবে? এর নাম কি করে "পরীক্ষা" হয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময় অনার্স থার্ড ইয়ারে আমরা 'অল্টারনেটিভ ডেভেলপমেন্ট' পড়েছিলাম। সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল "টেকসই উন্নয়ন" টেকসই উন্নয়নের বেসিক কথা ছিল যে, প্রত্যেকটা সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে উন্নয়ন কর্মসূচি নিলে সেটা হবে টেকসই উন্নয়ন। আমেরিকান সমাজের জন্য যা প্রযোজ্য তার বাংলাদেশের সমাজের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। আবার যেকোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি নিতে হলে সেটা গ্রহণ করার মতো বা বাস্তবায়ন করার মতো সমস্ত লজিস্টিক সাপোর্ট আছে কিনা তাও বিবেচনা নিতে হয়। জানি না- এই ধরনের দেখে লেখার পরীক্ষা পদ্ধতি আমেরিকা, ব্রিটেনে বা অন্য কোথাও চালু আছে কিনা। যদি চালু থাকে তাহলে কোন প্রেক্ষাপটে এবং কোন কোন সামাজিক রাষ্ট্রীয় লজিস্টিক সাপোর্টের ভিত্তিতে এই ধরনের "দেখে লেখা পদ্ধতি" চালু করা সম্ভব হয়েছে বা প্রয়োজন হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। আর আমেরিকা বা ব্রিটেনে বা উন্নত কোন দেশে এরকম পদ্ধতি চালু হলেই যে তা বাংলাদেশের গ্রহণ করতে হবে এরও তো কোন অর্থ নেই। 

আজকে যারা এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছেন তারা কি আমেরিকান সিস্টেমে লেখাপড়া করে সেই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছেন? তারা কোন মেধা মননে বা জ্ঞান বুদ্ধিতে বাংলাদেশে এই পদ্ধতি চালু করলেন? আমার দুই ভাইঝি বা এরকম কোমলমতি শিশু-কিশোর সবাই বলে থাকে- এই লেখাপড়া তাদেরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোন লেখাপড়া শেখা তাদের হচ্ছে না। আমিও মাঝে মাঝে তাদের লেখাপড়ার ধরন বা বইয়ের কনটেন্ট দেখা বোঝার চেষ্টা করেছি। খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। বর্তমান পরীক্ষার পদ্ধতি এবং লেখাপড়ার যে ধরন বইয়ের কন্টেন্ট তাতে আসলে সন্তুষ্ট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানাবো- দয়া করে মগজ থেকে অন্তত এই পরীক্ষা পদ্ধতি ঝেড়ে ফেলুন। ফিরে আসুন স্বাভাবিক পদ্ধতিতে। তা না হলে জাতির ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকারে পড়বে। কারণ আজকের শিশু-কিশোররাই তো কয়েক বছর পরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শুরু করবে। তখন তাদের ভান্ডারে কি থাকবে? এসব কি কখনো ভেবেছেন??