যেমন গেল ঢাকাই ছবির চলতি বছর

যেমন গেল ঢাকাই ছবির চলতি বছর

বিনোদন ডেক্স :  প্রয়াত চলচ্চিত্র সাংবাদিক মোহাম্মদ আওলাদ হোসেনের কথা ধরেই বলতে হয়, ‘আশা-নিরাশার সমুদ্রে গন্তব্যহীন ছুটেছে ঢাকাই ছবির জাহাজ। হারানো দিন ফিরে পেতে সবার আগে চাই একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য। তারপর চাই দক্ষ একজন নাবিক’। কোথায়, কবে পূরণ হবে সেই প্রত্যাশার; কেউ জানি না। চলতি বছরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা ইন্ডাস্ট্রিতে বাড়ছে চলচ্চিত্র, বাড়ছে বাজেট, বাড়ছে নির্মাতা ও শিল্পী, বাড়ছে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশাও। অন্যদিকে কমছে সিনেমা হল, কমছে বাজার, কমছে গল্পের মান, কমছে সাফল্যের সংখ্যা। আমাদের ষাট বছরের গৌরবময় ইতিহাসের চলচ্চিত্র শিল্প এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে তার পুরোনো দিনগুলো ফিরে পেতে। নানা নেতিবাচকতার পাশাপাশি বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও চোখে পড়েছে। তবে মন্দটাই বেশি করে চোখ রাঙাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলে বসছেন ইতিহাসের জঘন্যতম একটি বছর কাটল ঢালিউডে। চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান হালচিত্র নিয়ে লিখেছেন লিমন আহমেদ

বাড়ছে ছবি ও নতুন মুখ
চলতি বছরে ছবি নির্মাণের সংখ্যাটা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। অসংখ্য নতুন নির্মাতা ও শিল্পীদের অভিষেক ঘটেছে এবার। তবে এদের বেশিরভাগই ছিলেন ভিন্ন ধারার ছবির কলাকুশলী। তাদের মধ্যে বেশ কিছু ছবি আলোচিত হয়েছে এবং দেশে বিদেশে নানা পুরস্কার ও প্রশংসা জিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দুর্দান্ত প্রতিনিধিত্ব করেছে। তাল মিলিয়ে বেড়েছে বাণিজ্যিক ছবিরও পরিমাণ। বরাবরের মতো এবারেও সর্বাধিক ছবির নায়ক হতে যাচ্ছেন ঢালিউডের নাম্বার ওয়ান হিরো শাকিব খান। তার পাশেই থাকবে আনিসুর রহমান মিলন, বাপ্পি ও সাইমনের নাম। পাশাপাশি মুক্তি পেয়েছে আরিফিন শুভ, শাহরিয়াজ, আরজু, সুমিত, জায়েদ খানসহ বেশ ক’জন নায়কের ছবি। ছোট পর্দা থেকে এসেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশাররফ করিম, অপূর্ব, সৈয়দ আরেফ প্রমুখেরা।

এদের মধ্যে বছর জুড়েই নানা চরিত্রে অভিনয় করে চলচ্চিত্রে আলোচিত ছিলেন চিত্রনায়ক মিলন। নায়িকাদের মধ্যে সর্বাধিক ছবির মালিক হতে যাচ্ছেন বছরের সেরা ফ্লপ নায়িকার তকমা পাওয়া পরীমনি। চলতি বছরেই অভিষেক হওয়া এই সুন্দরীরর পাঁচটি ছবিই মুক্তি পেয়েছে এবার। তারপরই উল্লেখ করা যায় অপূ বিশ্বাস, মাহিয়া মাহি, আঁচল, মৌসুমী হামিদ, ববি ও আইরিনের নাম। একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে চিত্রনায়িকা কেয়ার। পরীমনির পাশাপাশি এ বছরে অভিষেক হয়েছে আরো বেশ ক’জন নায়িকার। তারমধ্যে অনন্য মামুনের ‘ভালোবাসার গল্প’ ছবিতে মুনিয়া আফরিনের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে।

কিন্তু চমৎকার অভিনয় করেও ‘১৮+’ ছবির নায়িকা হয়ে সমালোচিত হয়েছেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী মৌসুমী নাগ। তবে অভিষিক্ত নায়িকা হিসেবে সাফল্যের বিচারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন মৌসুমী হামিদ। সাফি উদ্দিন সাফি পরিচালিত ‘ব্ল্যাকমানি’ ছবি দিয়ে বড় পর্দায় পা রাখেন এই লাক্স সুন্দরী। এই ছবিটিকে ধরা হচ্ছে বছরের অন্যতম ব্যবসা করা ছবিগুলোর একটি হিসেবে। লাভের গুড় খুব বেশি ঘরে তুলতে না পারলেও মন্দার এই বাজারে ছবিটি তার লগ্নির টাকা ফেরত পেয়েছে। পাশাপাশি মৌসুমী নন্দিত হয়েছেন ‘ব্ল্যাকমেইল’ ও ‘জালালের গল্প’ ছবি দু’টিতেও।

বছরের শেষদিকে মুক্তি পাওয়া ‘অনিল বাগচির একদিন’ ছবি দিয়ে আলোচনায় এসেছেন জ্যোতিকা জ্যোতিও। অভিষেকে তেমন সাফল্য পাননি ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ ছবির নায়িকা চ্যানেল আই-ভিট মডেল সানজিদা তন্ময় ও ‘লালচর’ ছবির নায়িকা মীম। তবে চলতি বছরটা রাঙিয়ে নিয়েছেন লাক্স তারকা বিদ্যা সিনহা মিম। তিনি হলেন এই বছরের সর্বাধিক বাজেটের ছবি ‘পদ্ম পাতার জল’র নায়িকা। তার এই ছবিটি বক্স অফিসে মুখ থুবরে পড়লেও বছরের শেষ দিকে কলকাতার সোহমের সাথে যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘ব্ল্যাক’ দিয়ে ব্যবসা সফল ছবির নায়িকার তকমাও পেয়েছেন এই সুন্দরী।

সাফল্য পেয়েছেন লাক্স তারকা জাকিয়া বারী মম। শিহাব শাহীনের পরিচালনায় ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবি দিয়ে তিনি পেয়েছেন প্রশংসা ও ব্যবসায়িক সাফল্যও। তার বিপরীতে ছিলেন আরিফিন শুভ।

আর বছরের ব্যবসা সফল নায়িকাদের শীর্ষে রয়েছেন ‘লাভ ম্যারেজ’ ও ‘রাজাবাবু’ ছবি দিয়ে অপু বিশ্বাস ও ‘অগ্নি-২’ ছবি দিয়ে মাহিয়া মাহি। তারপরের স্থানটিতে রাখা যায় চলতি বছরের আলোচিত চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়ার নাম। তার ‘আশিকি’ ছবিটির সাফল্য জাজ মাল্টিমিডিয়াকে নন্দিত করেছে।

ছেলে, রিয়েলিটি শোসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনায় থাকলেও এ বছরে কোনো ছবি আসেনি ঢাকার পোলা খ্যাত চিত্রনায়ক অনন্ত জলিলের।

কমছে সিনেমা হল
সিনেমা হলকে বলা হয় ছবির প্রাণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সেই প্রাণশক্তিটা দিন দিন কমে যাচ্ছে ঢাকাই ছবির। এর প্রভাবে ধস নামছে চলচ্চিত্র শিল্পে। যে সিনেমা হলগুলো এখনও টিকে আছে সেগুলোর বেশির ভাগেরই চেহারা দেখলে মনে হয় দুর্ভিক্ষের নাগপাশে বন্দি সেসব। শুধু তাই নয়, বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পঞ্চগড় ও ঝালকাঠি- এই চারটি জেলায় কোনো সিনেমা হল নেই। এদিকে, সিরাজগঞ্জ জেলার চালা ও বেলকুচি থানায় মোট সাতটি হল ছিল। ঢাকার আগে এখানে ছবি মুক্তি পেতো। এখানকার একেকটি সিনেমা হল থেকে প্রযোজকরা একটি প্রিন্টের জন্য পেতেন চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। এখন সেখানে চালু রয়েছে পাঁচটি হল। এখানেই শেষ নয়, দুবছর আগেও সারা দেশে ৫০০’র বেশি সিনেমা হলে সিনেমা দেখতেন দর্শকরা। আর এখন সারা দেশে সিনেমা হল আছে ৩০০ এর মতো।
সিনেমার মন্দা বাজার এবং ছবির স্বল্পতা না কাটিয়ে উঠতে পারলে মালিকদের পক্ষে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট শীর্ষস্থানীয়রা।

এখনো সেরা শাকিব-অপু
চলতি বছরে মুক্তি পেয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিক চলচ্চিত্র। এসব ছবিতে কাজ করেছেন শতাধিক নায়ক-নায়িকা। তাদের নিয়েছে হয়েছে অনেক এক্সপেরিমেন্ট, যাছাই-বাছাই। চেষ্টা চলেছে নতুন জুটি নির্মাণের, নতুন ভাবনায় সাফল্য প্রাপ্তির। কিন্তু সব কিছুকে পিছনে রেখে বরাবরের মতো এবারেও সেরা ব্যবসা সফল জুটি শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস। বছরের সেরা দুটি ব্যবসা সফল ছবির মালিক এই জুটি। তারমধ্যে ২০১৫ সালের সর্বাধিক ব্যবসা করা ছবির নাম ‘লাভ ম্যারেজ’। শাহিন সুমন পরিচালিত এই ছবিটির বাজেট ছিল প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ। মূলধন বাদে ছবিটির লাভ হয় ৪০-৪৫ লাখ টাকা। এই ছবি এবং রাজাবাবু ছবির সাফল্য দেখেই আবারো শাকিব-অপূকে নিয়ে ছবি নির্মাণে ঝোঁক বেড়েছে নির্মাতাদের। আসছে বছরে দুটি ছবি মুক্তি পেতে যাচ্ছে ঢাকাই ছবিতে জুটি হয়ে সর্বাধিক ছবির মালিক এই দুই তারকার। সেগুলো হলে রাজের ‘সম্রাট’ ও বুলবুল বিশ্বাসের ‘রাজনীতি’। শাকিব-অপুর পরই উল্লেখ করা যায় ‌‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবির জুটি শুভ ও মম’র নাম। আলোচনায় ছিলো ওম-মাহি, অঙ্কুশ-নুসরাত ফারিয়া, বাপ্পি-আঁচল, সাইমন-মৌসুমী হামিদ, আরজু-আইরিন জুটিও। আর ছবি মুক্তি না পেলেও মেন্টাল ছবিতে শাকিব-তিশা ও সত্ত্বা ছবিতে আলোচনায় ছিলো শাকিব-পাওলি দামের জুটিটি। পাশাপাশি ব্যবসা সফল না হলেও অলিকের ‘আরো ভালোবাসবো তোমায়’ ছবিতে ভালোই প্রশংসা পেয়েছে শাকিব খান-পরীমনি জুটিও।

নাম যখন চলচ্চিত্রের মুলধন
চলচ্চিত্র একটি বিশাল মাধ্যম। এখানে অনেক কিছু ভেবেচিন্তে পা রাখতে হয়, কাজ করতে হয়। অনেকে অপেশাদার নির্মাতা ও প্রযোজকরাই এখানে এসে হোচট খেয়ে ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে। এটা কাম্য নয়। তেমনি কোনো আলোচিত বিষয় বা ঘটনাকে ছবির উপজীব্য করে ব্যবসা করার চিন্তাটাও বিকলাঙ্গ মানসিকতার। নির্মাতা বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে মাথায় রাখা উচিত তারা কি বানাতে যাচ্ছেন, কী বিষয় নিয়ে বানাতে যাচ্ছেন। যে বিষয়টি তারা চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করছেন সেটি ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, হলে সেটি দর্শক কিভাবে নিবেন-এইসবও ছবি নির্মাণের পরিকল্পনায় পড়ে। কেননা, চলতি বছরে এইরকম কিছু বেদনাদায়ক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে ইন্ডাস্ট্রি। তারমধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, নজরুল ইসলাম খানের নিষিদ্ধ ছবি ‘রানা প্লাজা’র নাম। ২০১৩ সালে সাভারে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনা থেকে পরিচালক ছবির নাম বাছাই করেছেন। দেশের ইতিহাসে বেদনাদায়ক একটি দুর্ঘটনা থেকে নাম নিয়ে পরিচালক বলছেন এটি প্রেমের ছবি! এখানে দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমকেই উপজীব্য করে দেখানো হয়েছে যার শেষটা একটা করুণ পরিনতির মধ্য দিয়ে!! এর চেয়ে নির্মম আর কী উপহাস হতে পারে। কেন একটি প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে পরিচালককে দুই হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনাকে টানাটানি করতে হলো- এই প্রশ্ন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের। আর যদিই বা নির্মাণ করলেন তবে তিনি কী এমন নির্মাণ করলেন যে ছবিটি আদালতে তিন তিন বার নিষিদ্ধ হয়ে অবশেষে রাষ্ট্রপতির দরবার পর্যন্ত গিয়েছে এবং সেখানেও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এসেছে? হয়তো এর উত্তরে অনেক জবাব-যুক্তিই রয়েছে নির্মাতার কাছে। কিন্তু চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে এই ছবির গল্প ও নির্মাণ নিয়ে সমালোচনাকে তিনি মুছে দিতে পারবেন না। সমালোচনার পাশাপাশি নষ্ট হয়েছে নজরুল ইসলাম খানের ইমেজও। সেইসাথে তিনি সমালোচিত করেছেন প্রজন্মের দুই প্রতিশ্রুতিশীল অভিনয়শল্পী পরীমনি ও সাইমনকেও; যারা সবে মাত্র নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ছেন। একইভাবে উল্লেখ করা যায় ২০ নভেম্বর মুক্তি পাওয়া রওশন আরা নীপার ‘মহুয়া সুন্দরী’ ছবির কথা। জনপ্রিয় ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে তিনি ছবির নামকরণ করেছেন। কিন্তু ছবিতে ময়মনসিংহ গীতিকার উপস্থাপন কিছু গান ছাড়া আর কোথাও মিলেনি। মানহীন নির্মাণ আর দুর্বল অভিনয়ে ভরপুর ছবিটি। যা নাচ-গানের পাগল দর্শকদের মন ভরালেও সমালোচিত হয়েছে রুচিশিল দর্শক শ্রেণির কাছে। সরকারি অনুদানে এমন অপরিপক্ক চলচ্চিত্র কাম্য নয় বলেই দাবি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের।

যৌথ প্রযোজনার নামে প্রতারণা
যখন ঢাকার ছবির জোয়ার ছিলো তখন যৌথ প্রযোজনার ছবি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলো ইন্ডাস্ট্রিতে। দেশি তারকাদের পাশাপাশি সেসব ছবিতে দর্শকরা পেতেন পাকিস্তান-ভারত-শ্রীলংকাসহ অন্যান্য দেশের বিখ্যাত তারকাদের অভিনয় দেখার সুযোগ। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের চলচ্চিত্রের সেই দিন আর নেই। বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। নেই সেই হৃদয় ছোঁয়া গল্প, সেই নির্মাণ। সেই মানের নির্মাতা-শিল্পী ও কলাকুশলীও। কিন্তু রয়ে গেছে যৌথ প্রযোজনার প্রাচীন ব্যবস্থাটি। পরিতাপের বিষয় হলো বিগত কয়েক বছর ধরেই চরম অনিয়মের মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে দুই দেশের প্রযোজনার ছবিগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি দারুণভাবে আলোচনায় এসেছে। অভিযোগ উঠেছে, যৌথ প্রযোজনার নামে যারাই ছবি নির্মাণ করেছেন তারা প্রতারণা করছেন দর্শকদের সাথে। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন কলকাতার রাজা চন্দ ও ঢাকার কিবরিয়া লিপুর যৌথ পরিচালনায় ছবি ‘ব্ল্যাক’।

ছবিটিতে প্রথমবারের মতো জুটি হয়েছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় দুই তারকা কলকাতার সোহম এবং বাংলাদেশের মিম। ছবিটি যৌথ প্রযোজনার কোনো নিয়মই মানেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য মন্ত্রনালয় ছবিটির ব্যাপারে তদন্ত করতে কমিটি গঠন করেছেন। যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় তবে ছবিটিতে আটকে দেয়া হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে যৌথ প্রযোজনার অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলো সর্বপ্রথম জাজ মাল্টিমিডিয়াই। এখনো তারা নিয়ম-নীতি না মেনেই কলকাতার এসকে মুভিজের সাথে মিলে ছবি নির্মাণ করে যাচ্ছে। ঢাকাই ছবিতে ১৯৭৩ সাল থেকে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ শুরু। আলমগীর কবিরের পরিচালনায় ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবির মাধ্যমে চালু হয় এ প্রক্রিয়া। একই বছর ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটি মুক্তি পায়।

তবে প্রথমবারের মতো যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা প্রণীত হয় ১৯৮৬ সালে। সেই নীতিমালার সংশোধিত রূপ প্রকাশ পায় ২০১২ সালে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজকাল যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে সেই নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন বেশিরভাগ নির্মাতারা। ২০১২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথ প্রযোজনা ইস্যুতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না তা তদারকির আসলে কেউ ছিল না। দৃশ্যপট পাল্টে যায় ২০১৪ সালে। ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ খ্যাত পরিচালক অনন্য মামুনের ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ সিনেমাটির বিরুদ্ধে ‘নীতিমালা লঙ্ঘন`-এর অভিযোগ এনে সেন্সর বোর্ডের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগেরও দ্বারস্থ হয় তারা। সে সময় পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার জানিয়েছিলেন, সিনেমাটি যৌথ প্রযোজনার ৬ নং ধারাকে ‘অমান্য করেছে’।

এ ধারায় দুই দেশের শিল্পী সংখ্যা সমানুপাতিক হারে নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও তা অনন্য মামুন করেননি, এমনকি তিনি ভারতেই বেশিরভাগ শুটিং সেরেছেন বলে অভিযোগ আনেন গুলজার। পরিচালক সমিতির তোড়জোড়ে সিনেমাটির বিরুদ্ধে নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে তথ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র বিভাগ। চলচ্চিত্র বিভাগের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব (চলচ্চিত্র) রেবা রাণী সাহাও বলেছিলেন, ‘সিনেমাটি নীতিমালা মানে নি।’ যদিও আইনী প্রক্রিয়ায় অনন্য মামুনের সিনেমাটির প্রদর্শনী ঠেকানো যায়নি। তবে পরিচালক সমিতি থেকে মামুনের সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হয়। তাই বলে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা ভাঙায় অভিযুক্ত বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা এসকে মুভিজ কিন্তু বসে থাকেনি।

‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ব্যবসাসফল হওয়ার পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলে এসকে মুভিজ। এরপর ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘আশিকী’ ‘অগ্নি-২’সহ আরো বেশ কিছু ছবি তারা নির্মাণ করেছেন এবং করে চলেছেন।

খসে যাওয়া নক্ষত্রেরা
চলতি বছরে অনেক প্রাপ্তির সাথে বিয়োগও এসেছে ঢাকাই ছবিতে। আমাদের চিরতরে চলে গেছেন বেশ ক’জন প্রিয় মানুষ। তাদের আর কোনোদিন চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবতে দেখবে না কেউ। এ বছরে পরপারে পাড়ি জমানো চলচ্চিত্রের মানুষদের মধ্যে সবার আগেই স্মরণ করছি ঢাকাই ছবির এনসাইক্লোপিডিয়া খ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক মোহাম্মদ আওলাদ হোসেনকে। তারপর শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল চলচ্চিত্র অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম আদিল, চিত্রনায়ক মিঠুন, চলচ্চিত্রাভিনেত্রী অমিতা বসু, রানু দাশ, নাগমা, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা আনোয়ারসহ চলতি বছরে চলে যাওয়া সকল চলচ্চিত্রের মানুষদের।

তাল কেটেছে চলচ্চিত্রের গানে
চলচ্চিত্রের সোনালী দিনে দেখা যেত প্রতিটি ছবিতেই অন্তন একটি হলেও শ্রুতিমধুর গান থাকতো। সেইসব গান মাসের পর মাস ঘুরে বেড়াত শ্রোতাদেরে মুখে। পরিতাপের বিষয় বিগত কয়েক বছর ধরেই প্রাণ হারিয়েছে চলচ্চিত্রের গান। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রইল চলতি বছরেও। হাতে গোনা দুই-একটি গান কিছুটা আলোচনায় এলেও তেমন করে সাফল্য বলতে যা ‍বুঝায় সেটি জুটেনি কোনো চলচ্চিত্রের ভাগ্যে। যদিও হাবিব ওয়াহিদসহ দেশের নামী দামী সংগীত পরিচালক, গিতীকার, শিল্পীরাই গান করেছেন।

কৃষ্ণপক্ষে হোক নতুন শুরু
অনেক আলোচনা আছে, অনেক সমালোচনা আছে। তার ভিড়েই চলছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। সবাই নতুন শুরু চায়। আমরাও চাইছি। আর সে চাওয়া পূরণে এবার আমাদের অপেক্ষা মেহের আফরোজ শাওনের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘কৃষ্ণপক্ষ’র জন্য। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটিতে প্রথমবারের মতো জুটি বেঁধে অভিনয় করছেন ঢাকাই ছবির জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজ ও নতুন প্রজন্মের শীর্ষ অভিনেত্রী মাহিয়া মাহি। ছবিটিতে আরো রয়েছেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস, আজাদ আবুল কালাম, তানিয়া আহমেদ, মৌটুসি বিশ্বাস, মাসুদ আখন্দ, আরফান প্রমুখ। গল্প, অভিনয়, গান আর নির্মাণের মুগ্ধতায় দর্শকদের আবারো হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের এই ছবিটি সেই প্রত্যাশাই রইল। এই মিছিলে যোগ হোক মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ‘সম্রাট’, বুলবুল বিশ্বাসের ‘রাজনীতি’, রফিক শিকদারের ‘ভোলা তো যায় না তারে’র মতো মৌলিক গল্পের ছবিগুলো।