হাজীদের ৬ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

হাজীদের ৬ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

বিশেষ প্রতিবেদক : অতিরিক্ত কোটায় পাঠানো পাঁচ হাজার হাজীর বাড়িভাড়া নিয়ে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সমতলে বাড়িভাড়ার কথা বলে পাহাড়ে চড়া দামে ভাড়া দেখিয়ে ছয় কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে এই হাজীদের ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত ১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সদস্য হাবের সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। এই গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ করছেন হাবের বর্তমান কমিটির নেতাসহ ওই কমিটির অন্য সদস্যরা।

ইতোমধ্যেই মক্কা হজ মিশনে কাউন্সিলনকে (হজ) বিষয়টি মৌখিকভাবে অবহিত করা হয়েছে। হাবের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করার দাবি জানিয়ে আগামী সোমবারের মধ্যে ধর্ম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব বরাবর লিখিতভাবে অভিযোগ করা হবে বলে জানিয়েছেন হাবের নেতারা।

তবে অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য সৌদি আরবে অবস্থানরত জামাল উদ্দিনের সাথে বারবার তার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অভিযোগ উঠার পর থেকে তিনি উপরিউক্ত কমিটির অন্য সদস্য, হাব নেতা ও হজ মিশনকে এড়িয়ে চলছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে সৌদি সরকার অতিরিক্ত পাঁচ হাজার হজযাত্রী পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে কোটা দেয়ার পর প্রথমেই মক্কা হজ মিশনের সহায়তায় বাড়িভাড়ার কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। কাগজপত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হলেও মূল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালিত হয় হাবের নেতৃত্বে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। সে ক্ষেত্রে এই হজযাত্রীদের ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ১০ সদস্যদের একটি কমিটি করে দেন। কমিটির অন্যতম সদস্য জামাল উদ্দিনকে সৌদি আরবে অবস্থানরত তার ভাইয়ের সহায়তায় মক্কা ও মদিনায় সমতলে বাড়িভাড়া করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়।

কথা হয়েছিল মক্কায় হাজীপ্রতি ৪০০ ও মদিনায় ১২০ সৌদি রিয়েল করে মোট ৫২০ রিয়েলের মধ্যে বাড়িভাড়া করা হবে। বাড়ি ভাড়ার জন্য অগ্রিম টাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় সরকারি কোষাগার থেকে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু জামাল উদ্দিন তার ভাইয়ের সহায়তায় মক্কায় মসজিদুল হারাম থেকে চার কিলোমিটারের বেশি দূরে কোদাই পাহাড়ে আটটি বাড়িভাড়া করেন। ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ রিয়েলের মধ্যে ভাড়া করলেও তারা ভাড়া দেখায় ৮০০ রিয়াল। অন্য দিকে মদিনায়ও ভাড়া দেখায় ২২০ রিয়াল। এই হিসাবে হাজীপ্রতি এক হাজার ২০ রিয়েল হিসাব করে সমুদয় টাকা হজ মিশন থেকে নিয়ে নেন। সময় স্বল্পতা ও তড়িঘড়ির কারণে এবং ব্যবস্থাপনা কমিটির সবাই তখন দেশে থাকায় বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি।

কিন্তু পরে হাজীরা যাওয়ার পর দেখা যায় বাড়িগুলো পাহাড়ের ওপর। কমিটির অন্য সদস্যরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ভাড়াও করা হয়েছে দেখানো ভাড়ার প্রায় অর্ধেকে। এ ছাড়া সেখান থেকে হাজীদের পক্ষে হেরেম শরীফে আসা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। হাবসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে জামাল উদ্দিনের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে নানা অজুহাত দেখিয়ে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে হাবের পক্ষ থেকে হাজীদের জন্য আবার হেরেম শরীফের কাছে বাড়িভাড়া করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

কিছু এজেন্সি নিজেদের উদ্যোগেও হাজীদের কাছে রাখার ব্যবস্থা করে। এ দিকে মদিনায় হাজীদের বাড়িভাড়া করার ক্ষেত্রে তারিখের হেরফের করার অভিযোগ উঠেছে। যেখানে অতিরিক্ত কোটার হাজীদের ফিরতি ফাইট ১৯ অক্টোবর থেকে শুরু হবে সেখানে মদিনায় এই হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া করা হয় ১৭ অক্টোবর থেকে। ফলে অনেক হাজীর ১০ দিন মদিনায় থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরে হাবের উদ্যোগে আবারো হাজীদের জন্য মদিনায় বাড়িভাড়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে আজ থেকে অতিরিক্ত কোটার হাজীদের মদিনায় পাঠানো হচ্ছে বলে দেশে ফেরত হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ জানান।

অতিরিক্ত হজযাত্রীদের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য রুহুল আমিন মিন্টু ফোনে নয়া দিগন্তকে অভিযোগ করে বলেন, আল্লাহর মেহমান হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া নিয়ে এমন অনিয়ম করা হবে আমরা ধারণাও করতে পারিনি। হাবের সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দিনকে আমরা দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু হাজীদের জন্য যে বাড়ি তিনি ভাড়া করিয়েছেন তা বয়স্ক হাজীদের থাকার অনুপযোগী।

পাহাড় ভেঙে তাদের আসা-যাওয়া করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া ভাড়াও নিয়ে নিয়েছেন দ্বিগুণেরও বেশি। আমরা ধারণা করছি, কমপক্ষে ছয় কোটি টাকা এখান থেকে লোপাট করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মৌখিকভাবে মক্কায় কাউন্সিলর হজকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা হজযাত্রী ও এজেন্সি মালিকদের নিয়ে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে হজ মিশনে যাব।
ব্যবস্থাপনা কমিটির অপর সদস্য হাবের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল কবির খান জামানও অনিয়মের অভিযোগ করে বলেন, অনিয়ম তো অবশ্যই হয়েছে। বিষয়টি কাউন্সিলর হজকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। কমিটির সদস্যরা আজকালের মধ্যে দেশে ফেরার পর বৈঠক করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

জানতে চাইলে হাবের মহাসচিব শেখ আব্দুল্লাহ বলেন, বাড়িভাড়ায় যে অনিয়ম হয়েছে এর সাথে হাবের কোনো সম্পর্ক নেই। বাড়িভাড়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল হাবের সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দিনকে। তিনিই অনিয়ম করেছেন। হাজীদের জন্য সমতলে চারটি বাড়িভাড়ার কথা বলে, পাহাড়ে আটটি বাড়িভাড়া করা হলো। হাজীদের কষ্ট দেখে আমরা পরে হেরেম শরীফের কাছাকাছি থ্রি ও ফোর স্টার হোটেল ভাড়া করে নিয়ে আসি। তিনি বলেন, মদিনায়ও এমন সময় বাড়িভাড়া করা হয়েছে যে দু’দিন পর থেকেই হাজীদের ফিরতি ফাইট।

তাহলে হাজীরা কি মাত্র দুই দিন মদিনায় থাকবেন। এই অবস্থায়ও আমরা নতুন করে বাড়িভাড়া করে শনিবার থেকেই হাজীদের মদিনায় নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। তিনি বলেন, আমরা বাড়িভাড়ার বিষয়টির তদন্ত দাবি করছি। আমরা এ ব্যাপারে লিখিতভাবেও অভিযোগ করবো এবং তদন্ত দাবি করবো। আগামী সোমবারের মধ্যেই ধর্মমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগসংবলিত চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানান।

এ দিকে অভিযুক্ত জামাল উদ্দিনের সাথে অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল বিকেল থেকে সৌদি আরবে তার ব্যবহৃ মোবাইল ফোনে বার বার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে নিজের পরিচয় দিয়ে এবং অভিযোগের বিষয় উল্লেখ করে মেসেজ পাঠিয়ে পুনরায় ফোন করার পরও ফোন রিসিভ করেননি।

তথ্যসূত্র : নয়া দিগন্ত।