বিপদ কাটিয়ে জওত্লাং জয়ের গল্প

বিপদ কাটিয়ে জওত্লাং জয়ের গল্প

ভ্রমন ডেক্স, টাঙ্গাইলদর্পণডটকম : প্রচলিত বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য মোতাবেক দুমলংকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মনে করা হতো। যদিও সরকারি তথ্য এটা বলে না। এ সম্পর্কে সরকারি তথ্যগুলোর বিভ্রাট অনেকবারই প্রমাণিত হয়েছে। যেমন সরকার স্বীকৃত দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বিজয় বা তাজিনডংয়ের স্থান বর্তমানে দশের মধ্যেও নেই। বরং সাবেক সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডাংয়ের অবস্থান বর্তমানে পাঁচ নাম্বারে রয়েছে। যাই হোক, দুমলং অভিযানের পরিকল্পনার শেষ পর্যায়ে জানা গেল জওত্লাংয়ের নাম। এটিই আসলে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।

অভিযাত্রী দলের সকলের ইচ্ছায় এবার আমাদের লক্ষ্য পরিবর্তিত হলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম জওত্লাং যাব। মিজো থেকে এসেছে ‘জও’ শব্দটি। আর বম শব্দ ‘ত্লাং’ অর্থ পাহাড়। এর অবস্থান বান্দরবান জেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত রেখায়। এই অভিযান ছিল একটু ব্যাতিক্রম। কারণ আমরা থানচী থেকে নৌকার পরিবর্তে পায়ে হেঁটে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। এবং সে উদ্দেশ্যে যথারীতি পৌঁছে গেলাম থানচী বাজারে। 

থানচীর অপরূপ বিশেষত্ব হলো সেখানে মেঘ কুয়াশার খেলা চলে চারপাশের পাহাড়ের গায়ে গায়ে। সেখানে অল্পদিন আগে নির্মিত সেতুর রেলিং ধরে দাঁড়ালে মুহূর্তেই মেঘ এসে শরীর ছুঁয়ে যায়। দিয়ে যায় সিক্ত কোমল পরশের আদর। দিগন্তের দিকে তাকালে দূরের পাহাড় সারি ক্রমেই মিলে যায় অলস মেঘের আড়ালে। কাপড় পরিবর্তন করে ছুটলাম সাঙ্গুর পাড় ধরে উজানে। জানা পথ, চেনা প্রকৃতি, ব্যাতিক্রম কেবল বাহন। নৌকার জায়গায় পদযুগল ভরসা। কয়েক ঘণ্টা ট্রেকিংয়ের পর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সামনে কোনো ট্রেইল নেই।

অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি জায়গা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে তারপর বাধ্য হয়েই আমাদের নৌকায় উঠতে হলো। ঘাটে একটি মাত্র নৌকা ছিল। জনপ্রতি একশ টাকা দাবি করে বসল। অথচ পথ মাত্র পনেরো মিনিটের। সবাই মিলে চারশ-তে রাজি করানো গেল। কিন্তু তারপর তার দাবি হলো আগে টাকা দিতে হবে। টাকা হাতে না পেলে নৌকা ছাড়বে না। কারণ জানতে চাইলে বলল, ‘বাঙালিদের ভালোভাবেই চিনি!’

পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই অনেক দিন হলো। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় পাহাড়িদের নিকট থেকে এমন ব্যবহার আগে কখনও পাইনি। অপমানিত বোধ করলেও উপলব্ধির বিষয় হলো, এ আসলে তার একার অভিব্যক্তি নয় বরং গোটা পাহাড়ি সমাজের। আমরা, আমাদের রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ তাদের সম্বন্ধে যদি সার্বক্ষণিক অবিশ্বাস ও অনাস্থা পোষণ করি; আর দমন-পীড়নের কথা না-ই বা বললাম, সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপারে তাদের এমন মনোভব অস্বাভাবিকতার পর্যায়ে পড়ে না। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে নৌকায় উঠলাম। নৌকা থেকে নামার পর পুনরায় ট্রেকিং শুরু হলো। নদীর দুপাড় মিলিয়েই ট্রেইল। সুতরাং ঠান্ডা পানিতে এপার ওপার করতে করতে পায়ের অবস্থা কাহিল! এরপর কোথাও আবার পাহাড়ের স্যাঁতসেঁতে কালো দেয়ালের খাঁজ ধরে ধরে এগুতে হয়। আবার কোথাও ট্রেইল এগিয়েছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে। বিকেল চারটায় এসে পৌঁছলাম নাম না জানা এক অপরূপ সুন্দর জায়গায়।

সেখানে দু-তিনটি খাবারের দোকান মিলল। সন্ধ্যা নিকটবর্তী, তাই দোকানীর পরামর্শে আর অগ্রসর না হয়ে তার দোকানঘরেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাতের খাবারে থাকল জুম চালের ভাত, আর নদী থেকে সদ্য শিকার করা মাছের ঝোল। ভিন্ন রকম এক পরিবেশে রাত দ্রুত গভীর হতে থাকল। সামনে পাহাড়, পেছনে পাহাড়, মাঝে নদীর স্রোতের মন মাতানো শব্দ। ঠিক তার পাড়ে বাঁশের বেড়ার ছোট্ট দোকান ঘর আর তার ভেতর আমরা ক’জন ভিন্ন জাতের মানুষ। পেছনের ঘরটাতে দোকানী, তার স্ত্রী ও তিন সন্তান। কথা বলে জানলাম, কেউ আশ্রয় প্রত্যাশা করলে তারা ফেরান না। যে কারণে এত সহজে আমাদের সেখানে থাকা সম্ভব হলো। দলিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিতরা এমনই হয়ে থাকে। সব কিছু জটিল করে ভাবে না, ভাবতে জানে না তারা।

ভোরে ঘুম ভাঙে নদীর কুলকুল করে বয়ে যাওয়া পানির শব্দে। ধবধবে সাদা কুয়াশার গভীর পড়তে ঢাকা পরেছে সবকিছু। কানে কেবল ছুটে চলা স্রোতের শব্দ এবং দুটি একটি পাখির হঠাৎ চিকন কণ্ঠের মিষ্টি ডাক। কুয়াশার পড়ত ভেঙে হেঁটে চললাম। পরবর্তী গন্তব্য মৌজা-প্রধান পাড়ার উদ্দেশে। শীতের মৌসুম হলেও দিনের বেলা  পাহাড়ের পৃষ্ঠে রোদের তাপমাত্রা বেশ কড়া থাকে। এক পর্যায়ে দেখলাম, পাহাড়ের মাথায় যাত্রা বিরতির জন্য রয়েছে ছোট্ট ছাউনি। সেখান থেকে ট্রেইল নিচের দিকে নেমে গেছে। পথিমধ্যে দেখা হলো মৌজা-প্রধানের সাথে, জরুরি কাজে রওনা করেছেন উপজেলা সদরের দিকে। সাথে একজন দেহরক্ষী। সবলদেহী রক্ষীর হাতে একটি দা। পরনের লুঙ্গি টেনে তুলে পশ্চাৎদ্দেশের মাঝখান দিয়ে জোরে-কষে মালকোচা মারা।

মৌজা-প্রধান আমাদের অভিপ্রায় জানতে পেরে বললেন, সমস্যা নেই ঘাটে পৌঁছার পর ধানওয়াকে (রক্ষী) পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে আপনাদের গাইডের দায়িত্ব পালন করবে। পাহাড়ের একেবারে মাথার ওপর পাড়ার অবস্থান, রুমা উপজেলাধীন সুংসংপাড়াকে সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন বলে জানতাম। কিন্তু না, এই পাড়া তার চেয়েও অধিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একটি শূকরও সেখানে উন্মুক্ত নয়, খাঁচায় আটকে রাখা। ঝকঝকে-তকতকে পাড়ার দীর্ঘ উঠানে ভুল করে যেন গাছের একটি পাতাও পরে নেই!

বেশ উন্নত এক বাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা হলো। ব্যাগ রেখে বসতেই একজন জানতে চাইল, চা-কফি পান করবো কিনা? নিমন্ত্রণ পেয়ে কপালে ভাঁজ পড়ল! আকারে-ইঙ্গিতে দলের সঙ্গীদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম, খামাখা টাকা খরচ করে লাভ কী? চা-তেই চালিয়ে নেয়া যাক!
কিন্তু আমরা চায়ের প্রস্তাব করতেই ভাঙ্গা বাংলায় বলা হলো- চা, কফি যোতাই খান তাকা দিতে হবে না যে।
এবার সত্যি সত্যি হোঁচট খেলাম। কিন্তু বুঝতে দিলাম না। স্বাভাবিকতার ভান করে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো ঠিকই। যেন আগে থেকেই জানা ছিল। খানিক পরেই পরিবেশিত হলো ধোঁয়া ওঠা গরম গরম কফি। স্বাদে একটু ভিন্ন।

কথাপ্রসঙ্গে জানলাম, কফি তাদের ঘরে প্রস্তুত করা। এবার সত্যি সত্যি বিস্ময়ে আমাদের উল্টে পড়ার দশা- বলে কী! বিস্ময় কাটাতে কফি গাছ দেখাতে নিয়ে গেলেন স্বয়ং দিদি। অল্প কয়েকটি গাছ, তাতে ধরে রয়েছে লাল সবুজ কফি গোটা। খানিক বাদে হিম শীতল জলে হাত মুখ ধুয়ে সতেজ হয়ে ফিরতে ফিরতেই শোয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। নিজস্ব তাঁতে বোনা মোটা কম্বলের বিছানা এবং গায়ে জড়ানোর জন্য দেয়া হলো প্রত্যেকের জন্য দুটি কম্বল। এর ফাঁকে রাতের খাবারের আয়োজন চলতে লাগল। খেতে বসে জওত্লাং আরোহণের পথঘাট সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে নিলাম।

পাড়ার কোনো লোকের সহযোগিতা ছাড়া জওত্লাং-এ আরোহণ অসম্ভব। কারণ ট্রেইল বলতে যা বুঝায় তা নেই। যেতে হবে অনুমানের ওপর, যা একমাত্র গাইডের সহায়তাতেই সম্ভব। রাতের খাবারে পরিবেশিত হলো স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়ায় রান্না করা ভাত, মুরগির মাংসের তরকারী। সাথে মুলার আস্ত লম্বা পাতার টলটলে ঝোল; খেতে অসাধারণ লাগল। পাঠককে জানিয়ে রাখি শুধুমাত্র লবণ ও টেস্টিং সল্ট দিয়ে এসব রান্না করা। সব শেষে বাটিতে সাজানো পেঁয়াজ ও মুলা কুচির সাথে পোড়ানো শুকনা মরিচ ও চিংড়ি শুঁটকির গুঁড়া মেশানো সালাদ। সব মিলিয়ে বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম।

পর দিন ভোর পাঁচটা, শীতের প্রকোপে জমে যাওয়ার অবস্থা। ঠিক আগের দিনের মতো মালকোচা মেরে কনকনে শীতে বাংলায় অপারদর্শী গাইড ধানওয়া মুড়ং এগিয়ে চললো। প্রায় অন্ধকার চারপাশ। শুকনো খটখটে পথ। দুর্গম এলাকা, স্থানীয়রা কালেভদ্রে শিকারের উদ্দেশে গিয়ে থাকে। ধনেশ, ভাল্লুক, শূকর ছাড়াও রয়েছে অনেক হরিণ। বেশ কয়েকটি জায়গায় হরিণের পায়ের স্পষ্ট ছাপ ও ধনেশ পাখির গোছা গোছা পালক দেখতে পাই। পথের প্রায় তিন চতুর্থাংশ পর থেকে শুকনো মাটির ঝুরঝুরে আবরণ, সে পথে ওঠা অধিক ঝুকিপূর্ণ। পাহাড়ের ঢালু শরীর বেয়ে ওঠা বা নামা উভয় ক্ষেত্রে ঝুলে থাকা লতা ভীষণ কার্যকরী, তবে পরখ করে নেয়ার ব্যাপার রয়েছে কারণ মরা বা শুকনো লতা হলে বিপদের যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। সঙ্গে জিনিসপত্র বলতে পিঠের ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার ও প্রায় তিন লিটার পানি। সবার সঙ্গেই এই একই জিনিস। পানির মজুদ ঠিকঠাক রাখা জরুরি কারণ পথের এক পর্যায়ে পানির কোনো উৎস নেই।

সব শেষে দুই ঘণ্টা পথ উঠতে হয় ছোট ছোট বাঁশের ঘন বনের মাঝ দিয়ে। পাশাপাশি উটকো উৎপাত হিসেবে রয়েছে স্থানীয়দের ভাষায় বিষ পাতা। একবার সেই পাতার সংস্পর্শে এলে আর রক্ষা নেই। শুরু হয় চুলকানি। আমরা বিষ পাতা এড়িয়ে পথ চলতে লাগলাম। কিন্তু পথ তো ফুরায় না, ঘন বাঁশের তল থেকে আন্দাজ করাও দুস্কর! আর কত দূর, জানতে চাইলে ধানওয়া হাত ইশারায় শুধু বলল, উঠতে থাকো। মাঝে মাঝে সে আবার হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে মুখে আঙুল চেপে শশশ করে ওঠে। নিকটে জন্তু-জানোয়ারের সাড়াশব্দ পেলে সে অমন করে। আমরাও তখন ভয়ে চুপ করে যাই। অজানা আশঙ্কায় মন কেঁপে ওঠে।

অবশেষে পথ ফুরালো। শৃঙ্গে আরোহণ করতে সক্ষম হলাম বেলা ১১.৪৭ মিনিটে। অবস্থানের জন্য সময় নির্ধারিত হলো ত্রিশ মিনিট। কারণ সন্ধ্যার আগেই বেজক্যাম্পে পৌঁছাতে না পারলে যেখানে রাত সেখানেই কাত অর্থাৎ থেকে যেতে হবে। শৃঙ্গের পূর্ব পাশটা মিয়ানমারের সুবিশাল পার্বত্য অঞ্চল। কোনো জুম অথবা বসতি চোখে পড়ে না, কেবল পাহাড়ের সারি আর সারি। সাকাহাফং (বেসরকারিভাবে দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ) ও তিনমুখ পিলার (বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের আন্তর্জাতিক সীমার মিলন বিন্দু, বেসরকারিভাবে যা অষ্টম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ) থেকে সীমান্তের ওপারের যে রূপ চোখে পড়ে দেশের দ্বিতীয় এই সর্বোচ্চ জওত্লাং থেকেও ঠিক একই। শৃঙ্গে রাখা একটি বোতলে আটকানো দুইটি সামিট নোট ও বেজক্যাম্পের এন্ট্রি লিস্ট মোতাবেক আমরা বোধহয় জওত্লাং সামিট করা তৃতীয় অভিযাত্রী দল।