ঝুঁকির মুখে মুক্ত সাংবাদিকতা, এগিয়ে বাংলাদেশ

ঝুঁকির মুখে মুক্ত সাংবাদিকতা, এগিয়ে বাংলাদেশ

মিডিয়া ডেক্স, টাঙ্গাইল দর্পণ ডট কম : ক্রমেই ঝুঁকির মুখে পড়ছে মুক্ত সাংবাদিকতা৷ আরো একবার তার প্রমাণ পাওয়া গেছে মঙ্গলবার সিটি নির্বাচনের সময়৷ মোট ২১ জন সাংবাদিক ঐ দিন হয় পুলিশ অথবা শাসক দলের ক্যাডারদের হাতে হামলার শিকার হন৷ এখনও এর কোনো প্রতিকার হয়নি৷

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা প্রধানত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন৷ বলা বাহুল্য, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের সুরক্ষা বা নিরাপত্তার জন্য বিশেষ কোনো আইন বা ব্যবস্থা নেই৷

গত মার্চে প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমানকে আটক করে পুলিশ৷ আর আটকের পর পুলিশ হেফাজতে ব্যাপক মারধোর করা হয় তাঁকে৷ তাঁর ওপর নির্যাতন হয়েছে বলে জানিয়েছে আদালতের নির্দেশে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডও৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে আটকের পর একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিয়ে চলেছে৷ তাই এখনো তিনি কারাগারে আছেন৷ উল্লেখ্য, মিজানুরের সঙ্গে এক পুলিশ সদস্যের কথা কাটাকাটির জের ধরে তাঁকে গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন করা হয়৷

ফ্রিডম হাউস নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৯৭টি দেশের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে, যার ফলাফলে দেখা গেছে, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং বেলারুশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সবচেয়ে কম৷ অন্যদিকে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা রয়েছে নেদারল্যান্ডস, সুইডেন এবং নরওয়েতে৷

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে দু'জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন৷ এছাড়া পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যু হয়ছে একজনের এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরো একজন সাংবাদিক৷ একই বছরে ২৩৯ জন সংবাদকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশে৷ এর মধ্যে ২১ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, ৫৬ জন সন্ত্রাসী এবং ৭৮ জন সাংবাদিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷

ওদিকে, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে তিনটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ এবং ডেইলি সান-এর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সরকারদলীয় সাংসদ সদস্যরা৷

অন্যদিকে, চলতি বছর সাংবাদিক নির্যাতনের পাশাপাশি ব্লগারদের ওপরও হামলা বেড়েছে৷ এ বছর এখনও পর্যন্ত দু'জন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে৷ তার পাশাপাশি আরো অন্তত পাঁচজন ব্লগারকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই তাই আতঙ্কে আছেন শতাধিক ব্লগার৷ উল্লেখ্য, গত এক দশকে বাংলাদেশে ২৩ জন সাংবাদিকককে হত্যা করা হয়৷ আর এ সময় নির্যাতনের শিকার হন প্রায় ৩,২৬৬ জন সাংবাদিক৷

তবে শুধু সাংবাদিক নয়, সংবাদমাধ্যমও রয়েছে চাপের মুখে৷ জানুযারি মাসে একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম ও এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলি ফালুকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ গ্রেপ্তার করা হয় একুশে টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি ড. কনক সরওয়ারকেও৷ অভিযোগ, সংবাদমাধ্যমের ওপর এক ধরণের ‘সেন্সরশিপ' চলছে বাংলাদেশে৷ একুশে টেলিভিশনের চিফ রিপোর্টার মঞ্জুরুল আলম পান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মুক্ত সাংবাদিকতা ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷ এই ঝুঁকি প্রতিষ্ঠানের ভিতরে যেমন আছে, আছে বাইরেও৷''

তাঁর কথায়, ‘‘সাংবাদিকরা পেশাগতভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের চাপের মুখে থাকেন, হুমকি এবং নির্যাতনের শিকার হন৷ এটা এই সরকারের আমলে যেমন হচ্ছে, অতীতেও হয়েছে৷'' তিনি অবশ্য এও বলেন, ‘‘কোনো কোনো সাংবাদিক বা সাংবাদিক নেতা নিজেরাই নিজেদের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেন৷ বিশেষ করে সাংবাদিকদের রাজনৈতিক লেজুড় বৃত্তি তাঁদের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংবাদিক নির্যাতন এবং হত্যার চিত্রই বলে দেয় যে বাংলাদেশে মুক্ত সাংবাদিকতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ৷'' তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে৷ সরকার এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ যেমন, পুলিশ-প্রশাসন সাংবাদিকদের প্রতি এক ধরণের নেকিবাচক আচরণ করে৷ আর তার প্রতিফলন অন্যান্য পেশি শক্তি ও সন্ত্রাসীদের মধ্যেও পড়ে৷ ফলে সাংবাদিকরা নানা ধরণের হুমকি এবং নির্যাতনের শিকার হন৷ এই সব নির্যাতন এবং হত্যায় বিচার না হওয়ায় পরিস্থতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে৷'' তবু তাঁর মতে, ‘‘বাংলাদেশে সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমে পেশাদারিত্বের অভাবও আছে৷ এটাও ঝুঁকির আরেকটি কারণ৷'' (ডি.ডব্লিউ)