গাজীপুরের ৪ গ্রামে হাতে ভাজা মুড়ি

গাজীপুরের ৪ গ্রামে হাতে ভাজা মুড়ি

গাজীপুরের ৪ গ্রামে হাতে ভাজা মুড়ি

অনেকেই রুচির পরিবর্তনে হাতে ভাজা মুড়ির প্রতি আকৃষ্ট হন। আর তাদের চাহিদা মেটাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বগারপুর, বহেরাতলী, পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর উপজেলার বারতোপা, জৈনাতলী গ্রামে সারা বছরই হাতে মুড়ি ভাজা হয়...

শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি

অনেকেই রুচির পরিবর্তনে হাতে ভাজা মুড়ির প্রতি আকৃষ্ট হন। আর তাদের চাহিদা মেটাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বগারপুর, বহেরাতলী, পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর উপজেলার বারতোপা, জৈনাতলী গ্রামে সারা বছরই হাতে মুড়ি ভাজা হয়।

ওইসব গ্রামের প্রায় ৩০টি পরিবার হাতে মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতি বছর হাজার হাজার মণ ধানের মুড়ি ভাজা হয় এসব গ্রামে। রমজান মাসে এর চাহিদা বেশি থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে আরো কয়েকটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে হাতে মুড়ি ভাজা হয়।

৫ মণ ধানের মুড়ি ভেজে ৫ জন শ্রমিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা মজুরি পান। মুড়ির বেপারীরা ধান কিনে পরিবারের মধ্যে সরবরাহ করেন। পরে তারা ধান শুকানো, সেদ্ধ করা, ভাঙানো এবং সর্বশেষ মুড়ি তৈরির কাজটি করেন। মুড়িগুলো স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হয় না। এগুলো রাজধানীর গাবতলী, আমিনবাজার, মিরপুর, কাওরানবাজার এলাকায় সরবরাহ করা হয়।

বারতোপা গ্রামের বানিছ সিকদার জানান, এলাকার মধ্যস্বত্বভোগী পাইকারেরা প্রতিবারে তাকে ১৫০ মণ ধান সরবরাহ করেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে রোদে শোকানো, সেদ্ধ করাসহ ১০ মণ ধান প্রক্রিয়া করতে তাদের এক মাস সময় লেগে যায়। পরে সর্বোচ্চ দুই দিনে তারা মুড়ি ভাজতে পারেন।

কালিয়াকৈরের বগারপুর গ্রামের মৃত সাহেব আলীর ছেলে উদ্যোক্তা বিল্লাল হোসেন জানান, ইরি ও শাইল আবাদের সময় নাটোর ও বরিশাল থেকে বেপারীরা তাকে ধান সরবরাহ করেন। প্রতিবারে ২০ মণ ধান সরবরাহ করেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে তারা কয়েকজন উদ্যোক্তা একত্রে সমন্বয় করে ১৫ দিনের মধ্যেই মুড়ি সরবরাহ করতে পারেন। লোকবল নিয়ে প্রতি বছর ১ হাজার মণ ধানের মুড়ি ভাজতে পারেন।

তিনি জানান, বাড়ি থেকে তিনি কিছু মুড়ি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। পাইকারি কেজি ৮৫ ও খুচরা কেজি ১শ’ টাকা বিক্রি করেন। ভালো মানের ধান হলে মূল্য বেশি হয়ে থাকে। ৪০ কেজি ধানে ২৩/২৪ কেজি মুড়ি হয়। একেক সময় একেক মূল্যের ধান সরবরাহ করা হয়। ধানের মূল্য সাধারণত ১৪শ’ টাকা মণ হয়ে থাকে। ভালো মানের ধানের মূল্য ১৭/১৮শ’ টাকা মণ হয়ে থাকে। প্রতিবারে আড়াই’শ কেজি মুড়ি ডেলিভারি করতে পারেন।

মুড়ি শ্রমিক মৃত কেরামত আলীর স্ত্রী রূপজান (৬৫) বলেন, যে শ্রমিক ভাজা চাউল গরম বালিতে মেশান তার মজুরি ৫শ’ টাকা। অন্যান্য সহযোগীদের ৪শ’ টাকা করে দেয়া হয়। মুড়ি শ্রমিক শাহিদা খাতুন (৩৮) জানান, উদ্যোক্তা আর শ্রমিকদের মধ্যে সমন্বয় আছে। আমরা কষ্ট করে প্রতি সাড়ে ৫শ’ মণের বিপরীতে ওই পরিমাণ পারিশ্রমিক পাই। এতে দেখা যায় ধান ভাঙানো বাদে একেকজন গড়ে ৫শ’ টাকা মজুরি পান। যা উদ্যোক্তাসহ ৫ জন শ্রমিকের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। শ্রমিক বেশি হলে মজুরি কমে আসে এবং সময় কম লাগে। নিজেরা ধান কিনে মুড়ি ভাজতে পারলে ভালো লাভ পাওয়া যেত। কিন্তু মূলধন না থাকায় এলাকার অর্ডার সরবরাহকারী ও বেপারীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভোক্তা পর্যন্ত মুড়ি পৌঁছাতে মাঝখানে চারজনের হাত বদল হয়।

একই গ্রামের মৃত সাইজ উদ্দিনের স্ত্রী উদ্যোক্তা কমলা খাতুন (৪৫)বলেন, বেপারীরা ধান দেয়। প্রথম দিন গরম পানি করে ফেলতে হয়। তারপর সেদ্ধ, শোকানো ও ভাঙাতে হয়। আমরা ৩ হাজার, ৩২’শ টাকা পারিশ্রমিক পাই। ১১ মণ ধানের মুড়িতে ১০ কেজি লবণ ব্যবহার করি। রমজানের ১৫দিন আগে থেকে ১৫ রমজান পর্যন্ত মুড়ি বেশি অর্ডার পাওয়া যায়। তখন চাহিদা বেশি থাকে।

তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো চালান নাই, মুড়ি ভাজতে ভালো লাভ পাওয়া যায় না। এলাকায় সুলভ মূল্যে লাকড়ি পাওয়া যায়। তাছাড়া আমরা মুড়ি ভাজার কাজটা ভালো জানি। তাই এ পেশায় লেগে আছি। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়ে কল কাখানায় চাকরি-বাকরি করছে। সরকার যদি কিছু সাহায্য করতো তাহলে নিজেরাই ধান কিনে মুড়ি ভেজে বাজারজাত করতে পারতাম। এখন ধানের দাম বেশি। ধানের দাম কম হলে লাভ ভালো হতো।

একই গ্রামের ফজলুল হক বলেন, হাতে তৈরি মুড়ি দামে বেশি হলেও স্বাদ ভালো। জৈনাতলী গ্রামের আব্দুস ছামাদের ছেলে জাকির হোসেন বলেন, আমাদের চোখের সামনেই তারা মুড়ি ভাজেন। মুড়িতে ইউরিয়া সার বা বিষাক্ত কোনো কিছু মেশান না। স্থানীয় দোকানগুলোতে হাতে ভাজা মুড়ি কিনতে পাওয়া যায় না। তাই বাড়ি থেকেই খেতে খুব সুস্বাদু হাতে ভাজা মুড়ি কিনে নিয়ে যাই। দাম প্রতি কেজি খুচরা ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত থাকে।

জৈনাতলী গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী আবুল হাসান বলেন, দাম বেশি থাকায় এলাকায় হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা কম। এগুলো সাধারণত রাজধানীতে সরবরাহ করা হয়। তাই আমরাও হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করি না। যাদের প্রয়োজন হয় তারা উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে কয় করেন। যন্ত্র দিয়ে তৈরি মুড়ি ৭০ টাকা কেজি বিচিত্র করি।

এ বিষয়ে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের শ্রীপুর ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে’র শাখা ব্যবস্থাপক শাহীনুর নাহার মৌরী বলেন, তৃণমূলের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া হয়। তবে এককভাবে সমিতির বাইরে কাউকে ঋণ দেয়া হয় না। ঋণ গ্রহীতাদের ৪০ জনের একটি সমিতির আওতাভুক্ত হতে হয়। এর মধ্যে নারী ও পুরুষ সদস্যের অনুপাত হতে হয় অর্ধেক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত নারী সদস্য পাওয়া না গেলে সেখানে পুরুষ সদস্য দিয়েই সমিতি গঠন করা হয়। এ অর্থ বছরে সমিতি গঠনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/bangladesh/158427/গাজীপুরের-৪-গ্রামে-হাতে-ভাজা-মুড়ি