টাঙ্গাইলের শিল্প ও বাণিজ্য মেলা!  প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লটারির টিকেট

টাঙ্গাইলের শিল্প ও বাণিজ্য মেলা! প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লটারির টিকেট

নি:স্ব হচ্ছে টাঙ্গাইলের অনেকে ॥ শুরু হয়েছে চুরি ছিনতাই
টাঙ্গাইলের শিল্প ও বাণিজ্য মেলা!  প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লটারির টিকেট
 
 বিশেষ প্রতিবেদক :

টাঙ্গাইলের শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় অবৈধভাবে পরিচালিত লটারির ফাঁদে ফেলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে উল্লাস র‌্যাফেল ড্র এর কর্তৃপক্ষ। তারা প্রতিদিন ছয় থেকে আট কোটি টাকার লটারির টিকেট বিক্রির লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমে অনেকটা সফলতা পেয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় লাখ লাখ টাকার কর ফাঁকির এই আয়োজন নিত্যদিন চললেও বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। লটারি জেতার নেশায় টাঙ্গাইলবাসী নি:স্ব হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ছিনতাই শুরু হয়েছে।


জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্সের আয়োজনে সামি এন্টার প্রাইজ, মণিপুরী তাঁতী শিল্প ও জামদানী বেনারসি কল্যাণ ফাউন্ডেশন এর ব্যবস্থাপনায় জেলা কারাগারের পিছনে বনানী মাঠে গত ৭ এপ্রিল শিল্প ও বাণিজ্য মেলা শুরু হয়। ওই মেলায় উল্লাস র‌্যাফেল ড্র এর ব্যানারে ৮ এপ্রিল থেকে অবৈধ লটারীর নামে জুয়ার আয়োজন করা হয়। লটারিতে পুরস্কার হিসেবে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, মোটর সাইকেল, স্বর্ণের গহনা, ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোবাইল, টেবিল ফ্যান, ওয়াশিং মেশিনসহ প্রতিদিন ৫০টিরও অধিক পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লাস র‌্যাফেল ড্র এর আয়োজকরা প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার লটারী বিক্রির লক্ষ্য মাত্রা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। প্রথম দিকে তারা দুইশতাধিক পরিবহনের মাধ্যমে টাঙ্গাইল সদর ও আশ পাশের উপজেলাগুলোতে লটারি বিক্রেতাদের পাঠিয়ে দিনভর লটারির টিকেট বিক্রি করেছেন। গত ২০ এপ্রিল থেকে জনবল কয়েকগুন বাড়িয়ে শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে, জনগুরুত্বপূর্ণস্থানে এমনকি স্কুল কলেজের আশপাশেও লটারি বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। লোভনীয় পুরস্কার আর মাধুরি মিশ্রীত শ্লোগানে মুগ্ধ হয়ে লটারি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। বর্তমানে ‘মামা মাথাই নষ্ট’ বাক্যটি টক অব দ্যা টাউনে পরিণত হয়েছে।

লোভনীয় পুরস্কার ঘোষণা করায় শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই লটারী নামক জুয়ার ফাঁদে পড়েছেন। এর ফলে শিশুরা টিফিনের টাকা দিয়ে ২০ টাকা মূল্যের লটারী কিনছেন। গৃহবধূরা তাদের সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে লটারীতে অংশ নিচ্ছেন। দিন মজুর, শ্রমিক, ভ্যান চালক, রিক্সা ও ইজিবাইক চালক, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবি সকলেই এই লটারি ক্রয় করছেন। অপরদিকে টিসি ভিশন নামক স্থানীয় ক্যাবল অপারেটরের মাধ্যমে লটারির ড্র সরাসরি সম্প্রচার করায় বিষয়টি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পড়া লেখা বাদ দিয়ে লটারির টিকেট মেলানোর জন্য রাত জেগে টিভির সামনে বসে থাকার খবর পাওয়া গেছে।

শহরের মালঞ্চ চরের আবু সাঈদের ছেলে রুহুল আমিন হাতের পাঁচ শেষ করে হোন্ডা পাবার আশায় পোষা চারটি কবুতর বিক্রি করেও টিকিট কিনেছেন। কোন পুরস্কার না পাওয়ায় বাবার ভয়ে তিনি আজ বাড়ি ছাড়া। ডিসি লেকের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, বাণিজ্য মেলার কারণে ডিসি লেকের ব্যবসা কমে গেছে। যারা বিকেলে বেড়াতে গিয়ে ফুসকা, চটপটি কিনতো তারা আজ ওই টাকা দিয়ে লটারী ক্রয় করছেন। আমিও লটারী প্রতিদিন কিনে থাকি। বটতলা বাজারের দোকন কর্মচারী সোহান, শহীদুল প্রতিদিন লটারী কিনে একদিনও বিজয়ী হতে পারেননি।
কুড়িগ্রাম থেকে টাঙ্গাইল মহাসড়কে রাস্তার কাজ করতে আসা জিবন রায় শখের বশে পাঁচটা লটারির টিকেট কিনেছেন। বৈল্লা বাজার এলাকার মো. জসিম উদ্দিন জানান, প্রত্যেক দিন আমি বিশটা করে টিকিট কিনি। দেখি কবে কপালে একটা হোন্ডা জোটে। ঘারিন্দা এলাকার রড মিস্ত্রী সুমন মিয়া অনেক টিকিট কিনলেও তার ভাগ্যে পুরস্কার জোটেনি।

নাগরপুরের হাফিজুল ইসলাম বিশ থেকে ত্রিশটা পর্যন্ত লটারির টিকিট কিনেছেন। অদ্যাবধি পুরস্কার জিততে পারেননি তিনি। গতকাল শনিবারও তিনি নিরালা মোড়ে এসে ভ্রাম্যমান লটারি বিক্রেতার নিকট থেকে দশটি টিকিট ক্রয় করেছেন একটি সিএনজি পাবার আশায়।
শনিবার টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন মোড়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় লটারির বক্স সাথে নিয়ে টিকেট বিক্রি করছেন অনেকেই। কথা হয় জয়পুরহাটের তরিকুল ইসলামের সাথে। তরিকুল ইসলাম নাম ঠিকানা বললেও অন্য কোন বিক্রেতা নাম ঠিকানা বা লটারি সংক্রান্ত কোন মন্তব্যই করতে রাজি হননি।

উল্লাস র‌্যাফেল ড্র এর ম্যানেজার রিয়াজ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক প্রগতির আলোকে জানান, লটারি টিকেট প্রতিদিনই নতুন প্রতীক ও পৃথক সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে বিক্রি করা হয়। একদিনের সাথে আরেক দিনের টিকেটের মিল নেই। লটারির টিকেটের প্রতিটি সিরিজের নম্বর এক লাখ এক থেকে শুরু করা হয়। কোনটি একলাখ বিশ হাজার বা ত্রিশ হাজার থেকে শুরু করা হয়ে থাকে। সকল প্রকার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে লটারি পরিচালনা করা হয়। তিনি কথা বলার সময়ও টিকেট কেনার জন্য ধন্যবাদ দেন এবং আরো লটারির টিকেট সংগ্রহের অনুরোধ করেন।
শহরে লটারির টিকেট বিক্রেতাদের নিকট থেকে সংগৃহীত টিকেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, উল্লাস র‌্যাফেল ড্র এর কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকার লটারির টিকেট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা অনেকটা সফল হয়েছেন। গতকাল শনিবারের লটারিতে বিজয়ীদের জন্য ছিল একটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, চারটি হুন্ডা, টিভি, মোবাইলসহ আকর্ষণীয় ৫৫টি পুরস্কার ছিল। আকর্ষণীয় এই পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে তারা শুধু শনিবারেই ৩০ লক্ষাধিক লটারির টিকেট বিক্রি করেছেন। যার মূল্য ছয় কোটি টাকার অধিক। শহর থেকে পাঁচটি সিরিজের টিকেট সংগ্রহ করে দেখা যায় সাদা রঙ এর ‘এ’ সিরিজের নয় লাখ দুই হাজার ৭৮৪টি টিকেট বিক্রি হয়েছে। ‘বি’ সিরিজের গোলাপী রঙ এর ৯লাখ ১৪ হাজার ৩০৫, হলুদ রঙ এর ‘সি’ সিরিজের ৬লাখ ১০হাজার ২৭টি টিকেট, সবুজ রঙ এর ‘ডি’ সিরিজের ৬লাখ ৭৫ হাজার ২৭টি এবং আকাশী রঙএর ‘ই’ সিরিজের ৫লাখ ১৪ হাজার ৫৬২টি টিকেট বিক্রি হয়েছে। যার মুল্য তিন কোটি টাকার অধিক।

এভাবে প্রতিদিন লটারির ফাঁদে ফেলে টাঙ্গাইলবাসীর নিকট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র।

প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার টিকেট কেনার অর্থ যোগাতে গিয়ে উঠতি বয়সীরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে। শহরে ছিচকে চোরের উপদ্রব বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় চুরির ঘটনা ঘটছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে টাঙ্গাইল চেম্বর অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিকে শিল্প ও বাণিজ্য মেলা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। লটারির জুয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে ফেসবুকে নানা ধরনের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। টাঙ্গাইল বাসীকে আস্বস্ত করার জন্য টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, “ ভুল বোঝার অবকাশ নেই। টাঙ্গাইল জেলার পণ্য সামগ্রীর বহুল প্রচার ও মান উন্নয়নের জন্য চেম্বার অব কমার্স টাঙ্গাইলকে বাণিজ্য মেলার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। জনস্বার্থের পরিপন্থি কোন কিছু এখানে হবেনা। আমরা বিষয়টি দেখছি।