তথ্য জানতে সবাই সক্রিয় হোন

তথ্য জানতে সবাই সক্রিয় হোন

ডেক্স নিউজ : ২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। ২০০২ সালে সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থার অংশগ্রহণে বুলগেরিয়ায় অনুষ্ঠিত তথ্যের স্বাধীনতা বিষয়ক সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে দিবসটি পালন শুরু হয়। তথ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, তথ্য প্রদানে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহী করে তুলতে তথ্য অধিকার দিবস এর গুরুত্ব অপরিসীম।

তথ্য কি, তথ্য জানার প্রয়োজনীয়তা ও তথ্য ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানাসহ সর্বোপরি তথ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও এই অধিকার অর্জনে প্রত্যেক মানুষেরই সক্রিয়া হওয়া প্রয়োজন। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, A right to information. Play your part. বাংলায় এর ভাবানুবাদ; ‘তথ্য একটি অধিকার: এ অধিকার আদায়ে আপনার ভূমিকা জরুরি’।

তথ্য অধিকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সহজ হবে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হয়ে উঠবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতির প্রভাব কমে আসবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩৯ (২-ক) এর মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক, ও বাক স্বাধীনতা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত। তথ্য প্রাপ্তির অধিকার এ অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তথ্য অধিকার আইন সংবিধানের ৩৯ ধারা অনুযায়ী স্বীকৃত। তদুপরি সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘প্রজতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। তথ্যের অবাধ প্রবাহই জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে পারে।

জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠালগ্নেই তথ্য অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার। এছাড়া সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ৬৬-তে (Universal Declaration of Human Rights, 1966) বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষেরই মতামত পোষণ ও প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। স্বাধীনভাবে মতামত পোষণ করা, যে কোন উপায়ে ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান করা, গ্রহণ করা ও জানার স্বাধীনতা এ অধিকারভুক্ত।

International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR), 1966  এর ১৯ অনুচ্ছেদে তথ্য পাওয়ার অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। The Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CEDAW) এর ১০ থেকে ১৬ নং ধারায় তথ্য অধিকার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সর্বজনীন শিশু অধিকার সনদে {Convention on the Rights of the Child (CRC)} তথ্য অধিকার সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে।

পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই তথ্য অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে সর্বপ্রথব তথ্য অধিকার নিয়ে ১৯৭৬ সালে আইন করে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৭০টি দেশে তথ্য অধিকার নিয়ে সরাসরি আইন পাস হয়। এছাড়া আরও অনেক দেশে অধ্যাদেশ বা অন্য আইনের সঙ্গে তথ্য অধিকার অন্তর্ভূক্ত থাকে। বতর্মানে পৃথিবীর শতাধিক দেশে তথ্য অধিকার নিয়ে সরাসরি আইন রয়েছে। দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ২০০২ সালে, ভারত ২০০৫ সালে (২০০২ সালে অধ্যাদেশ) ও নেপাল ২০০৭ সালে আইন পাস করে।

বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে দিবসটি উদযাপন শুরু হয়। তবে ২০০৮ সালে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ জারি করার পর সরকারও দিবসটি পালনে সক্রিয় হয়ে উঠে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৩তম দেশ হিসাবে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন পাস করে। তথ্য কমিশন গঠনের পর দিবসটি ব্যাপক পরিসরে পালন শুরু হয়। বর্তমানে শুধু তথ্য কমিশনই নয়, প্রায় সকল জেলা/উপজেলায় দিবসটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালন হচ্ছে।

বাংলাদেশের তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী “তথ্য” সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: ‘তথ্য’ অর্থে কোন কতৃপক্ষের গঠন, কাঠামো, দাপ্তরিক কর্মকান্ড সংক্রান্ত যে কোন স্মারক, বই, নকশা, মানচিত্র, চুক্তি, তথ্য-উপাত্ত, লগ বহি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি, দলিল, নমুনা, পত্র, প্রতিবেদন, হিসাব বিবরণী, প্রকল্প প্রস্তাব, আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও, অংকিত চিত্র, ফিল্ম, ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় প্রস্ততকৃত যে কোন ইনস্ট্রুমেন্ট, যান্ত্রিকভাবে পাঠযোগ্য দলিলাদি এবং ভৌতিক গঠন ও বৈশিষ্ট নির্বিশেষে অন্য যে কোন তথ্যবহ বস্তু বা উহাদের প্রতিলিপিও ইহার অন্তর্ভূক্ত হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, দাপ্তরিক নোট শিট বা নোট শিটের প্রতিলিপি ইহার অন্তর্ভূক্ত হইবে না।

এ আইনের অধিকতর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আইনের ১১ (১) উপ-ধারা অনুযায়ী তথ্য কমিশন(http://www.infocom.gov.bd) গঠন করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে একজন প্রধান তথ্য কমিশনার ও দু’জন কমিশনার (আবশ্যিকভাবে একজন নারী) নিয়ে এ কমিশন কাজ করছে। এছাড়া তথ্য অধিকার (তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা) প্রবিধানমালা ২০১০ এবং তথ্য অধিকার (প্রচার ও প্রকাশ) প্রবিধানমালা ২০১০, থ্য অধিকার (তথ্য প্রাপ্তি সংক্রান্ত) বিধিমালা ২০০৯ এর সংশোধনী মার্চ ২০১০-এ এবং তথ্য অধিকার (অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তি) প্রবিধানমালা ২০১১ ইত্যাদি জারি করা হয়। ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথ্য অধিকার আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে লিখিত প্রবন্ধ নবম ও দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০১৩ সালের শিক্ষাবর্ষ থেকে অন্তর্ভূক্ত হয়। এছাড়া তথ্য অধিকার ম্যানুয়াল ২০১২ প্রকাশ করা হয়।

তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৪ অব্দি সরকারি (মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তর/দপ্তর ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান) ও বেসরকারি (এনজিও, গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠানের ১৬,১০১জনকে আইন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে।

তথ্য কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০১০ সালে সারাদেশে তথ্য প্রাপ্তির আবেদন সংখ্যা ২৫,৪১০টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৯.৭% এবং ০.৩% (৭৫টি) নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১১ সালে ৭৮০৮টির মধ্যে ৯৭.৫৪% (৭১১৬টি) আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে। ১০৪টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি এবং ৮৮টি আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ২০১২ সালে ১৬৪৭৫টির মধ্যে ৯৫.৯০% আবেদন নিষ্পত্তি হয়। ২০১৪ সালে সারাদেশে ৮৪৪২টি আবেদন জমা পড়েছে, এর মধ্যে ৭৮৭০টি (৯৩.২২%) আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে।

তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার ছিল বেসরকারি সংস্থাসমূহ (এনজিও)। কিন্তু তথ্য প্রদানকল্পে তথ্য কর্মকর্তা ও আপিল কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থার দৈন্যতা লক্ষ্যনীয়। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর নিবন্ধনকৃত সংস্থার সংখ্যা ২৪১৪টি। অথচ আইন পাসের ছয় বছরেরও অধিক সময় পর ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখ অনুযায়ী, তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে মাত্র ৫৫২টি সংস্থা।  

তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে সিটিজেন চার্টার টানানো থাকে। এছাড়া ওয়েবসাইট, মূখপত্র, বার্ষিক প্রতিবেদন, ফেসবুক পেজ ইত্যাদি তথ্য প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাহ্যিক সহযোগী হতে পারে গণমাধ্যম। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক পেজ ও আইডিসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মাধ্যমে সহজে তথ্য প্রদান ও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গতবছর জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে জেলা প্রশাসনের ফেসবুক চালু করার নির্দেশনা দেয়া হয়। ফলে দেশের সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ফেসবুক পেজ চালু হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক জেলা তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন পেশাজীবীদের অন্তর্ভূক্ত করে গতবছর, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উদ্যোগে গঠিত উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য।

তথ্য প্রাপ্তি মানুষের অধিকার-এ সম্পর্কে জনমনে এখনও যথেষ্ট সচেতনতা নাই। আর যারা তথ্য অধিকার সম্পর্কে জানেন-তাদের মধ্যে অনেকে তথ্য নিয়ে সেটা নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করেন, যা তথ্য প্রদানকারীদের নিরুৎসাহিত করে। তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা অর্জন সর্বাগ্রে জরুরি। আস্থার সংকট দূর করতে পারলে তথ্য প্রাপ্তি ও প্রদানের পথ সুগম হবে।

তথ্য জানা যেহেতু অধিকার-তাই সবারই এই অধিকারের ইতিবাচক ব্যবহার করা দরকার। কারণ তথ্য জ্ঞান সৃষ্টি করে। জ্ঞান মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কট দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি জ্ঞানের ইতিবাচক চর্চা সমাজে কুসংস্কার, অন্যায়-অবিচার দূর করে। তথ্য জানতে ও জ্ঞানের ইতিবাচক চর্চা নিশ্চিত করতে সবাইকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সক্রিয় হতে হবে। এটাই এ বছর তথ্য জানার অধিকার দিবসের আহবান।