শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২
"আম্মা, আজ মাকলুবা রান্না কইরো। আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে। আজকে আর "না" বইলো না, প্লিজ। "--- মাকে জড়িয়ে ধরে আবদার করে আয়েশা।
মায়ের মন বিষন্নতায় ভরে উঠে। এই আবদার সে কয়েকদিন যাবৎ রোজ শুনে আসছে। কিন্তু, মেটাতে পারছে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, উপাদেয় খাদ্য সেখানে বিলাসিতা বৈ কিছু নয়।
কোনোমতে অশ্রু পারাবারে বাঁধ দিয়ে মুচকি হেসে মেয়েকে সান্তনা স্বরুপ বললেন: "আজ হবে না রে মা। দেখছিস না ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলো। বাজারে যেতে না যেতেই পথিমধ্যে আযান দিয়ে ফেলবে। এই অল্প সময়ের মাঝে কিভাবে রান্না করি বল? "মুলুখেয়া" দিয়ে না হয় আজকের ইফতারটা সেরে ফেলি? "
আয়েশা রোজকার দিনের মতো মাথা নেড়ে সায় দিল। কিন্তু, কোনো এক অচেনা অনুভূতির উদ্ভবে হৃদয়ের বাঁ পাশটায় হালকা মোচড় দিয়ে উঠলো। অতৃপ্ত রসনা সমুদ্রে ধৈর্যের তরী ইচ্ছের তীব্র হাওয়ায় মাঝে মাঝে গতি হারিয়ে ফেলে, কিন্তু বিবেক নামক দমকা হাওয়ার তোড়ে তরী তটেই ফিরে আসে।
গম্ভীর মুখ নিয়ে তাঁবুর জানালা খুলে বিছানায় বসে ভাবনার স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে যায়। যে রাজ্যে কোন দুঃখ নেই, আছে শুধুই কোমল সুখের স্পর্শ।
"মুলুখেয়া" নিয়ে মা তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করলেন। এটাই আজকের ইফতারের একমাত্র উপজীব্য। আয়েশা পাশের প্রতিবেশী তাঁবু হতে এক বোতল পানি চেয়ে আনলো। দুজনে ইফতার সামনে নিয়ে বসে আল্লাহর নাম জপছে। হঠাৎ, প্লেটভর্তি মুলুখেয়ার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন মা। আয়েশা হতবিহ্বল হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
বিবেকের কাঠগড়ায় তিনি আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সত্যের সারথি হয়ে অভাবের তাড়নায় মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। মুলুখেয়ার নামে তাঁর আট বছর বয়সী পঙ্গু কন্যাকে খবিজা নামক বন্য লতা, জরদ ঘাস ও লেবুর রস একত্রে সিদ্ধ করে খাওয়াচ্ছেন। জঠর জ্বালা সইতে না পেরে নিজেও খাচ্ছেন।
রমজানের প্রথম দিনে, মরুভূমিতে বেড়ে ওঠা কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাসের ভেতরকার পানসে অংশ দিয়ে ইফতার করেছিলেন। আজ সেহরীতে কিছুই জোটেনি। মা ও মেয়ে শুধুমাত্র এক মশক পানি পান করে রোজা রেখেছেন।
প্রতিনিয়ত এমন কষ্টকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে পুরো ফিলিস্তিনবাসী। এ বছর যুদ্ধ-বিরতির মাঝেই শুরু হয়েছে মহিমান্বিত রমজান। ইহুদিদের নগ্ন বসন্তকালীন উৎসব পাসোভার চলমান, তাই রমজান মাসের দোহাই দিয়ে ওরা এই যুদ্ধ-বিরতি কার্যকর করতে মরিয়া। এটা তো মামুলি প্রত্যক্ষ কারণ। কিন্তু, যুদ্ধ-বিরতির পেছনে আরও অনেক গুপ্ত পরোক্ষ কারণ বিদ্যমান।
মূলত, বেনগুরিয়নের বেহায়া উত্তরসূরীরা যুদ্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেছে, এখন ওদের পরিপূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। কন্ট্রোল রুমের ড্রোন নিয়ন্ত্রণকারী রক্তপিপাসু হায়েনারা মিসাইল ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্লান্ত পড়েছে, এখন ওদের পতিতা নারীর সুডৌল দেহ ভোগ করা প্রয়োজন। ১৫টি মাস ধরে গাজার বুকে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, এখন ওদের বারে গিয়ে বোতলের পর বোতল রেড ওয়াইন সাবাড় করা প্রয়োজন। অক্লান্ত পরিশ্রমে ওদের বেহাল দশা। এই মিথ্যা কথাটা ওরা সহজভাবে বলতে পারে না। তাই বিশ্রাম পর্ব সারতে যুদ্ধ বিরতির নাটক সাজিয়েছে। ওদের এই ভীমরতি বুঝতে পেরেছে হামাস। ওরা এই স্বল্প যুদ্ধবিরতির আহ্বান মেনে নেয়নি ও ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি দেয়নি। তাই যে কোন সময় যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠতে পারে।
এতো উদ্বেগ, আতঙ্ক ও খাবারের অভাবের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালন করছেন সাধারণ মানুষ। না খেয়ে যাদের দিন কাটে তাঁদের কাছে সংযম নতুন কিছু নয়, বরং এটা নিত্যকার ব্যাপার।
তবুও সবাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছে। শুকরিয়া তো এজন্য যে সেহরী ও ইফতারের সময় মিসাইলের আঘাতে কাঁপে না জমিন। শোনা যায় না স্বজন হারানো মানুষের গগনবিদারী আর্তনাদ।
কয়েকবছর আগের কথা মনে পড়ে। গাজায় তখন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি চলছিল। সেইবার রমজানে ফিলিস্তিন জুড়ে প্রবাহিত হয়েছিল আনন্দের ফোয়ারা। মাকলুবার চাইতে অনেক দামী খাবার রান্না হতো। পরিবারের সবাই মিলে সোমাগিয়া, মাফতাউল, মোসাখান, মানসাফ, হুম্মা, বিভিন্ন আচার ও সালাদ দিয়ে সেহরী ও ইফতার করতো। খাওয়ার মাঝে মাঝে পান করতো পুরনো জেরুজালেমের জনপ্রিয় জুস তামারিন। সেহরিতে ভারী খাবারের পর পনির ও দই ছিল নিত্যদিনের ডেজার্ট। কিন্তু, আজ এক প্লেট মাকলুবা ওদের জন্য স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজের অভিজাত শ্রেণির লোকেরা ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে শুধুমাত্র কয়েকটি শুকনো রুটি, মটরশুঁটির ঝোল ও স্বল্প পানি দিয়ে ইফতার সম্পন্ন করছে। অল্প ভাত ও সবজি যোগাড় করতে এখানে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। অনেক পরিবারে এক জনের খাবার ৬-৭ জন মিলে ভাগ করে খায়। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সংস্থা এসে ত্রাণ হিসেবে টিনজাত খাবার সরবরাহ করে। দিনের পর দিন এসব টিনজাত খাবার খেয়ে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
মুসলমানরা গাজার ভূমিতে চাষবাস করতে পারে না। দেশের সম্পূর্ণ আবাদি জমি ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। ওরা পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে মুসলমানদের আবাদকৃত ভূমিতে ঘৃণ্য গারকদ গাছ লাগিয়ে সয়লাব করেছে। তৃণভূমিতে জায়োনিস্টদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিদ্যমান থাকার কারণে গবাদি পশু পালনেও মুসলমানরা অপারগ। মাঝে মাঝে চাষযোগ্য জমিতে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে কৃষকের মৃত্যু সংবাদ অন্যান্য মুসলমানদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। মরুর বুকে খেজুর গাছ হতে শুরু করে ক্যাকটাসের ঝোপ পর্যন্ত ওদের করায়ত্তে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি বেনিয়ামিন প্রশাসনেরই চক্রান্ত। মাঝে মাঝে সীমান্তে ত্রাণ ও আমদানিকৃত পণ্য আটকে দিয়ে গাজায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায়, আসমান হতে ফায়সালা না আসা পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের কোনই পরিবর্তন ঘটবে না।
আযানের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলেন মা। পানি খেয়ে দু'জনেই রোজা ভাঙলেন। বিস্বাদ সিদ্ধ ঘাস খেয়ে কোনোমতে পেটের ছুঁচোকে থামিয়ে রাখলেন। ঈশার আযানের পূর্বেই আয়েশা ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো। তায়াম্মুম করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন মা।
খাবার পানি যেখানে দুষ্প্রাপ্য, অজুর পানির সরবরাহ সেখানে অকল্পনীয়। মায়ের খুবই ইচ্ছে ছিল মসজিদে গিয়ে ইমামের পিছনে নেকাবে দাঁড়িয়ে তারাবি নামাজ আদায় করবে। কিন্তু, সেটা এখন কল্পনার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো গাজায় একটি মসজিদেরও অস্তিত্ব নেই। মসজিদগুলো ওরা মিসাইলের আঘাতে গুড়িয়ে দিয়েছে। গত ৫ মাসের ইসরাইলি হামলায় ৫০০ এর অধিক মসজিদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজায় এখন আযানের সুরে মানুষ ও প্রকৃতি বিমোহিত হয় না। সম্মুখে খাবার রেখে আযানের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না। দলবেঁধে জিকির করতে করতে তারাবি নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদের ঐ পথ দিয়ে কেউ হাঁটে না।
সিজদায় নত হয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন। প্রতিটি "সুবহানা রাব্বিয়াল আলা"-তাসবিহের সাথে মনের অব্যক্ত ভাষায় স্রষ্টার কাছে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য চাইলেন। চোখের পানিতে জায়নামাজের বুকে ফরিয়াদের নহর বয়ে গেলো।
সালাম ফিরিয়ে বাইরে বের হয়ে তাঁবুর পাশেই একটি মরা খেঁজুর গাছের গুঁড়ির ওপর বসলেন। আকাশে রমজানের প্রজ্বলিত চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। মৃদু বাতাস বইছে। সামনের ওয়াদিতে চাঁদের প্রতিফলিত আলো বাতাসের ছন্দে আলো-আধারী খেলা খেলছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় সোনালী অতীত। ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যান। মুদিত চোখে সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে করতে নারকীয় স্মৃতিগুলো ত্রাসের কাঁপন সৃষ্টি করে মস্তিষ্কজুড়ে। তবুও অল্পসল্প সুখস্মৃতি মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরিতে কর্তব্যরত প্রহরীর ন্যায় পাহারা দেয়।
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরবর্তী শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা নাম রাখেন হালিমা। ছয় ভাইয়ের এক বোন তিনি। সবাই আদর করে রাসূল (সা.)-এর দুধ মাতা বলে ডাকতো। ছোটবেলায় ভাইয়েরা মক্তবে পড়তে যেতো। ভাইদের বই নিয়ে সে খেলা করতো। একদিন বই দেখিয়ে বাবার নিকট মক্তবে যাওয়ার বায়না ধরলো। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব? মেয়েদের তো পাঠশালায় যাওয়া মানা। উপায় বাতলে দিলেন বড় ভাই ওমর। বাড়িতেই ছোটবোনকে পড়াতে শুরু করলেন। দিন যায়, হালিমা খাতুনের মেধাও তত বিকশিত হয়। ঘরে বসেই তিনি প্রচুর বই পড়তেন। বাবার কাছে উচ্চশিক্ষা অর্জনের মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু, ইহুদিদের কলেজ-ভার্সিটিতে মুসলমানদের লেখাপড়া দূরে থাক বিনা অনুমতিতে প্রবেশটাই নিষিদ্ধ।
সেখানে কোনো এক মুসলিম নারীর বিদ্যার্জনের সুযোগ-যা অকল্পনীয়!! কিন্তু, হালিমা খাতুনের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের খুবই ইচ্ছে।
এই মহাসংকটে আবারও ত্রাতা রুপে হাজির হলেন বড় ভাই ওমর। তিনি বোনকে রাজধানী শহর বৈরুতের লেবাননী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। শুরু হলো গভীর তপস্যা ও অধ্যাবসায়। উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে দেশে ফিরে আসলেন। তখন পুরো দেশজুড়ে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধ চলমান।
লেবানন থেকে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের পর, হিজবুল্লাহ সীমান্ত বিরোধ এবং লেবানিজ বন্দিদের আটকের বিষয়ে ইসরায়েলের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছিল। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই, হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায়, যার ফলে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সীমান্তে অনুপ্রবেশ করলে আইডিএফ-এর মনোযোগ অন্যদিকে সরে যায়, এতে বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয় এবং আরও দুজনকে বন্দি করা হয়। লেবাননের বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ শুরু করে। বন্দি সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে আক্রমণ শুরু করে। এর শুরুতে বৈরুত পর্যন্ত উত্তরে অবকাঠামো লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান অভিযান চালানো হয় এবং পরে স্থল অভিযান চালানো হয় যার লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহকে ইসরায়েলি-লেবানিজ সীমান্ত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া। বেশ কয়েকজন আরব নেতা সংঘাত উস্কে দেওয়ার জন্য হিজবুল্লাহর সমালোচনা করেন, যার ফলে এক হাজারেরও বেশি লেবানিজ নিহত এবং প্রায় দশ লক্ষ বাস্তুচ্যুত হন।
এই সংকটের মাঝেই গাজার খান ইউনিসে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়। যেখানে দিনের বেলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার দরিদ্র শিশু, কিশোরী ও তরুণীরা লেখাপড়া করতো। আর রাতের বেলায় চলতো নিরক্ষর বয়স্ক মহিলাদের স্বাক্ষরতা প্রদানের অধ্যাবসায়। হালিমা খাতুনের ধারণা ছিল, এক মাত্র শিক্ষাই পারে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত এই ফিলিস্তিন জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
নারীরা স্বাবলম্বী হলে আর কিছু না হোক সংসারের অভাবটা ঘুচবে। এজন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাও প্রদান করতেন।
এভাবেই পেরুচ্ছিলো সময়। সংবাদপত্রের কল্যাণে হালিমার এই প্রতিষ্ঠানের খবর তেল আবিব পর্যন্ত পৌঁছায়। নড়েচড়ে বসে তৎকালীন ইহুদি প্রশাসন। সেনাবাহিনী নামক সাবেক হাগানা পাঠিয়ে বন্দি করা হয় হালিমাকে। তাঁকে আতঙ্কবাদী তথা জঙ্গি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। মিডিয়ার আশ্রয়ে বিদ্যালয়টিকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের ট্রেনিং সেন্টার বলে প্রচার করা হয়। তুলে আনা হয় তেলআবিব ডিটেনশন সেন্টারে। চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন ও যৌনত্যাচার। দলবদ্ধভাবে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয় হালিমাকে। নির্যাতন পর্ব শেষে রাখা হয় বন্দিশালায়। বানানো হয় সেনাদের যৌনদাসী।
দিনের বেলায় ভালো কাটলেও রাতের বেলায় সেনাদের উন্মত্ত যৌনাত্যাচারে দেহ হতে রুহ বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। কিছুদিন পর অন্তঃসত্ত্বা হলেন। ক্যাম্পের চুনসুরকি মোড়ানো সাদা ঘরে জন্ম দিলেন এক পুত্র সন্তানের। দায়িত্বরত কমান্ডার এসে আঁতুড়ঘরেই মায়ের সামনে নবজাতককে গুলি করে হত্যা করলো। অবলা মায়ের আর্তনাদে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে। চিৎকার শুনে কমান্ডার পরিহিত বুট জুতো দিয়ে মায়ের মুখ চেপে ধরে। তলানিতে থাকা শক্ত লোহার আবরণ দিয়ে ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে।
প্রস্থানের পূর্বে কমান্ডার বলে যায়:- "যতদিন পর্যন্ত তুই কন্যা সন্তান প্রসব না করবি, ততদিন তোর মুক্তি নেই। তোর গর্ভের পুত্রসন্তান এক একটা গাদ্দার হয়ে জন্ম নেবে। সাবালকত্ব অর্জন করার পর আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের স্পৃহায় হাতিয়ার তুলবে। আমরা কি সেটা নীরবে সইবো? তাইতো আঁতুড়ঘরেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলাম। মেয়ে সন্তান জন্ম দিলে তুই এখান থেকে মুক্তি পাবি। কিন্তু মেয়েটার গাত্রবর্ণ হতে হবে ফর্সা। কালো ও পঙ্গু মেয়ে জন্ম দিলে, তোকে কুকুরের সাথে সঙ্গম করিয়ে সেই কুকুরের খাদ্যে পরিণত করবো।"
এক বুক ব্যাথা নিয়ে মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকে। সেদিন রাতেও হায়েনাদের ভয়াল যৌনথাবা হতে রক্ষা পেলো না। এভাবেই কেটে গেলো আরও কয়েকটি বছর। মাঝখানে জন্ম নিলো ৩ টি পুত্র সন্তান। ওদের পরিণতি হলো বড় ভাইয়ের মতোই। যেবার আয়েশা দুনিয়ার আলো দেখলো, সবাই ভেবে নিয়েছিল এবারও পুত্র সন্তান জন্ম দেবে হালিমা। কিন্তু, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হলো।
কুলাংগার কমান্ডার নবজাতিকার যোনীতে থুথু নিক্ষেপ করে ঘোষণা দিলো: "আজ হতে এই মেয়ে ইয়াহুদী জনগণের সম্পত্তি। ১৪ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এই মেয়ে মায়ের কাছেই থাকবে। একে তোমরা এনা বলে ডাকবে। বয়ঃসন্ধি শুরু হলে ও আমার ব্যক্তিগত রক্ষিতা হিসেবে পরিগণিত হবে। আমার মৃত্যুর পর সে হবে সেনাদের যৌনদাসী। মা ও মেয়েকে একসাথে নিয়ে সম্মিলিত যৌন ক্রীড়ায় উপভোগ করে ওর যৌনজীবনের শুভ সূচনা করবো। "
নরপিশাচের এই ঔদ্ধত্য বচনের নিক্ষেপিত শরসম আঘাতে হৃদয় বিদীর্ণ হলো। প্রতিবাদ করাটা এখানে বোকামি বৈ কিছু নয়। খোদার দরবারে ফরিয়াদ জানিয়ে নীরবে সহ্য করা ব্যতীত কোনোই গত্যন্তর নেই। নবজাতকের নামটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে লুকিয়ে মেয়ের নাম রাখলেন আয়েশা। দিন যায় আয়েশা বড় হতে থাকে। ওর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভয় পায় মা। নাড়িছেঁড়া এই রক্তের ধনকে আর কয়েক বছর পরেই ছিনিয়ে নেবে ওরা-ভাবতেই হৃদয়ে শূল ফোঁটে।
"মেয়েটিকে ওই হায়েনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচাতেই হবে"-এই সংকল্পে অটল রইলেন মা। হঠাৎ একদিন পরিকল্পনার নিখুঁত ছক আঁকলেন। কয়েকদিন পর তা সূক্ষ্ম বুদ্ধিতে বাস্তবায়ন করতেও সমর্থ হলেন। মা ও মেয়ে দুজনেই সিঁড়ি থেকে নামছিল। হঠাৎ, মেয়েকে পরিকল্পনা মাফিক সিড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে পা ভেঙে গেল আয়েশার। মায়ের এই পরিকল্পনা কেউই বুঝতে পারলো না। বুকের পাজরে পাষাণ বেধে মেয়েকে অঙ্গহীন বানিয়ে পরাধীনতার বদ্ধ কুঠুরি হতে চিরদিনের জন্য মুক্তির বাতায়নে ফিরিয়ে আনলেন।
ক্যাম্পের কমান্ডার উন্মত্ত কুকুরের মতো ছুটে এসে দুজনকেই ইচ্ছেমতো লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগলো। বেয়নেট দিয়ে মায়ের ডান চোখ খুবলে নিলো। "এই পঙ্গু মেয়ে ওদের খায়েশ পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারবে না"-এই মর্মে বিবৃতি দিলো। মা এটা খুব ভালোভাবেই জানতো। দীর্ঘ ২ ঘন্টা যাবৎ অবর্ণনীয় নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে দুজনকেই রামাল্লার রাজপথে ফেলে দিয়ে গেলো। স্থানীয় মুসলমানরা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। দীর্ঘদিন পর তাঁরা দুজনেই সুস্থ হলেন। কিন্তু, মা হারিয়েছেন চোখ ও কন্যা হারালো পা।
পশ্চিম তীরে ফিরে আসলেন। পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন কেউই বেঁচে নেই। সেখানকার পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ও অর্থের ভগ্নদশায় একেবারেই কপর্দকহীন হয়ে রাফায় চলে আসলেন।
এখানকার প্রতিবেশীরা বেশ সাহায্য করলেন। শিক্ষক পরিচিতি শোনার পর সম্ভ্রান্ত এক মুরুব্বি এখানে একটি স্কুল খুলতে অনুরোধ করলেন ও এর বিনিময়ে মাসিক বেতন তাতে রাজি হলেন।
সবার সাহায্য নিয়ে অচিরেই একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলো।
শুরু হলো জীবনের নতুন এক অধ্যায়। ভালোই কাটছিলো সময়। কিন্তু, মাস কয়েক আগে ইসরায়েলি মিসাইলের আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ। হারিয়েছেন আবাস ও সেই সম্ভ্রান্ত মুরুব্বিকে, যিনি শত হতাশার ভগ্ন ইমরাতের মাঝে আশার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েকদিন খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে অবশেষে এক শরণার্থী সংস্থার উদ্যোগে এই তাঁবুতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে আর কতোদিন পেটের জ্বালা মেটানো যায়? তাইতো দিনের পর দিন অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। নিজে ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে পারেন। কিন্তু, অসহায় মেয়েটি তা পারে না। আয়েশার ক্ষুধার্ত শরীরের ঐ মলিন মুখটি বড়োই মায়াবী। দেখলেই মায়া জন্মায়, বুকের পাজর ভেঙে যায়, বুক ফেটে কান্না আসে।
ইফতারে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট সিদ্ধ ঘাস দিয়ে সেহরী খেলেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠে শুনতে পান, হামাস যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হওয়ায়, বেনিয়ামিন প্রশাসন ত্রাণের গাড়ি গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে না।
এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড কার্যকর করতে ওরা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করেছে। এতো মহাবিপদ। পুরো রমজান মাসটা কিভাবে কাটবে? মাথায় শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু তিনি ঘাবড়ে যান না। সিজদায় নত হয়ে কাঁদতে থাকেন। একটুপর খবর আসে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা কেন্দ্র UNRWA এর জাবালিয়া ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ করছে। মেয়েকে রেখে প্রতিবেশীদের সাথে হেঁটে জাবালিয়া ক্যাম্পে আসেন। পথিমধ্যে, এক ধনী আরব ব্যবসায়ী বিভিন্ন মুখরোচক খাবার বিতরণ করছে। সেখানে অনায়াসেই এক থালা মাকলুবা পেয়ে যায় মা। খাবারটি পলিথিনের প্যাকেটে রেখে সিজদায় নত হন। মোনাজাতে স্রষ্টার দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। বহুল প্রতীক্ষিত এই খাবার। ক্যাম্পের সম্মুখে প্রচণ্ড ভীড়ের সাথে যুদ্ধ করে তিন দিনের খাবার জুটলো। হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। ক্লান্ত শরীর আর চলতে চায় না। ইচ্ছে হয় মরুভূমির তপ্ত বালির বুকেই শুয়ে পড়তে। কিন্তু খাবার পাওয়ার পর মেয়ের হাসিমুখটি কল্পনায় চোখে ভাসলে মায়ের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আসার পথে অনেক কিছুই ভাবতে থাকে মা। মেয়েটা আজ কতোই না খুশি হবে।
ইফতারের একটু আগে মহল্লার সীমানায় প্রবেশ করেন। একটু এগোতেই দেখতে পান, মেয়েটি ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে হাত নেড়ে মেয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করলেন। খাবার ভর্তি পলিব্যাগ উঁচিয়ে ধরলে আয়েশা বুঝতে পারে মা ওর জন্য কোনো বিশেষ খাবার এনেছে। ক্রাচের পায়ার সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। মায়ের মন অচেনা এক আনন্দে ভরে উঠে। দীর্ঘদিন পর মেয়েকে পরম তৃপ্তিতে খাওয়াবে। আনন্দ অশ্রুতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
হঠাৎ, দ্রুম দ্রুম দ্রুম। কয়েকটা মিসাইল আঘাত হানলো পাশের অর্ধ ভগ্ন ভবনে। ওর হাত থেকে ক্রাচটা ছিটকে গেলো। কনক্রিটের ভগ্ন দেয়ালের নিচে চাপা পড়লো ছোট্ট দেহটি। নিমেষেই বের হলো ওর প্রাণবায়ু। চারিদিকে লোক জমে গেছে। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখের সামনে নাড়িছেঁড়া ধনের এমন মৃত্যু তাকে বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে। পারলো না, মেয়ের মুখে এক লোকমা মাকলুবা তুলে দিতে পারলো না। পূর্ণ হলো না মেয়ের অতৃপ্ত ইফতার। মনের ভেতরকার সৃষ্ট দামাল হাওয়ায় মস্তিষ্কের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারে তুফান উঠলো।মস্তিষ্ক সে অনুভূতির পসরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। হো হো রবে হেসে ওঠলেন মা। যে অট্টহাসিতে এক লহমায় বিকৃত হলো মস্তিষ্ক। কত যন্ত্রণার ফসল যে এই অট্টহাসি সেটা সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কেউ বুঝবে না। যাদের জন্য এই হাসির উৎপত্তি তাঁদের বিচার ঐ স্রষ্টাই সম্পন্ন করবেন। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।#