মোস্তাকিনদের দেশছাড়া করে ক্ষমতা নিশ্চিত করার পাঁয়তারা মোদির

মোস্তাকিনদের দেশছাড়া করে ক্ষমতা নিশ্চিত করার পাঁয়তারা মোদির

মোস্তাকিনদের দেশছাড়া করে ক্ষমতা নিশ্চিত করার পাঁয়তারা মোদির

এনআরসি বা সিএএ যাই বলুন না কেন, মোদি সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে হিন্দু ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা

গত বছরের আগস্টে ভারতের আসাম রাজ্যে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) প্রকাশ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য রাজ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গেও এই তালিকা প্রকাশ করার কথা জানিয়ে আসছে মোদির দল। মমতার রাজ্যে বারবার এনআরসি হবেই বলে হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন বিজেপির স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা। এ অবস্থায় নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন গোটা রাজ্যের সাধারণ মানুষজন। এই আতঙ্ক থেকে ইতিমধ্যে একাধিক মানুষের মৃত্যুর খবরও প্রকাশিত হয়েছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।

পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি আতঙ্ক যে কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে তারই এক নির্মম বর্ণনা দিয়েছে ভারতের বাংলা সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার।

মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পত্রিকাটি জানায়, ভারতের নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারছেন ওই রাজ্যের মোস্তাকিনের সাকিন নামের এক বাসিন্দা। তার ভয়, যে কোনো সময় হয়তো তাকে ‘বহিরাগত’সিলমোহর দিয়ে পাশের দেশ বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হবে। কেননা তার ভোটার কার্ডে তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

নিজের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আতঙ্কিত মোস্তাকিন ওই সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,‘ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে আঁতকে উঠছি গো! সে দিন নাকি ঘুমের ঘোরে বলছিলাম, ‘আমায় নিয় চলল গো’। শুনে বউ ভাবল ভূতে পেয়েছে!’

আসলে ঘুম কোথায়, এসবই তো তার দুঃস্বপ্ন। এনআরসি আতঙ্ক তো মোস্তাকিনের ঘুম কবেই কেড়ে নিয়েছে।

পশ্চিবঙ্গে এমন মোস্তাকিন একজন নয়, অগুণিত। আর মজার কথা হচ্ছে, এইসব আতঙ্কে থাকা মানুষগুলোর অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভয় নেই, কেননা তাদের আছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। মোদির দল তো, মুসলিম ছাড়া অন্য সব ধর্মের মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান করেই রেখেছে লোকসভা ও রাজ্যসভায় ওই বিতর্কিত আইন পাস করার মাধ্যমে।

ভোটার ও আধার কার্ডে নাম, ঠিকানা, বয়সসহ বিভিন্ন তথ্য ভুল আসার কারণে এভাবেই ছটফট করছে অসংখ্য গ্রামের মানুষজন। ভুল-নাম-ঠিকানার পরিচয় ঠিক করার চেষ্টায় দিন-রাত পড়ে আছেন সংশোধনের লাইনে। কোথাও পুরুষ নামের পাশে মহিলার ঘোমটা টানা ছবি। কোথাও বা  মহিলার নামের উপরে পোক্ত গোঁফের অচেনা পুরুষ।

ডোমকল এলাকার নাজমুল ইসলাম বলছেন, ‘ভোটার, আধার বা রেশন কার্ডে ভুল হামেশাই থাকে। এত দিন সে সব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। সবাই চেনে। তাই তা নিয়ে কেউ প্রশ্নও তোলেননি। কিন্তু এখন তো আর সে উপায় নেই, আর একটু যত্ন নিয়ে যদি কাজটা করত।’

একটা আধার কার্ড যেমন অন্ধকার ডেকে এনেছে ডোমকলের কুপিলা গ্রামের মালেক শেখের জীবনে। বছরখানেক আগে কার্ড হাতে পেয়েই প্রায় সংজ্ঞা হারানোর জোগাড় হয়েছিল তার। ৩৯ বছরের মালেকের বয়স দেখানো হয়েছে ১২। যা তার ছেলে নবিকুলের থেকে মাত্র এক বছর কম! মালেক বলছেন, ‘কী আজব ব্যাপার ভাবুন তো, এক বার ভেবে দেখল না, আমার ছেলের বয়স ১৩ আর আমার কি না ১২, হয় কখনও!’

ডোমকলের বাবলাবোনার একরামুল হকের ঠিকানা ছিল লালগোলা। হয়ে গিয়েছে অচেনা-অজানা এক গ্রাম।  রসুলপুরের আনোয়ার হোসেনের নামের পাশে লেখা ‘ফিমেল’। এরকম ভুলের তালিকা সুদীর্ঘ। ফলে হয়রানি ও আতঙ্ক বেড়েই চলেছে মোস্তাকিন আর নাজমুলদের। আরো আছেন আনোয়ার, ডোমকলের টগরী বিবির মতো মানুষেরা, তারা তো বুঝতেই পারছেন না অপরাধটা কি তাদের! 

তাই বুঝি ডোমকলের টগরী বিবির প্রশ্ন,‘শুনছি, কার্ডে ভুল পেলেই ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবে, তা আমাদের দোষটা কী বলেন দেখি, সরকারের ভুলে আমাদের এমন নাওয়া-খাওয়া ভুলে খেসারত দিতে হবে কেন?’

আর এ নিয়ে কারো কিছু করার নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে মুখে যতই আশ্বাস দিন না কেন।

আসামে গত ৩১ আগস্ট বহুল আলোচিত এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের ওপর এ নিয়ে চাপ বাড়িয়ে চলেছে ভারতের হিন্দুবাদি বিজেপি সরকার। যদিও আসামের ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুর সংখ্যা ১০ থেকে ১২ লাখ। আর বাঙালি মুসলিম বাদ পড়েছেন দেড় থেকে দু’লক্ষ। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও চাপের মুখে পড়ে স্থানীয় বিজেপি সরকার। এরপরই মোদি সরকার গত ডিসেম্বরে তড়িঘড়ি করে রাজ্যসভা ও লোকসভায় বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল)পাস করিয়ে নেয়। পরে এটি আইনে পরিণত হয়, যা নিয়ে গোটা ভারত জুড়ে এখনও বিক্ষোভ হচ্ছে।

ওই আইনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাড়ি জমানো মুসলিম শরণার্থীরা এই সুবিধা পাচ্ছেন না। বরং বিভিন্ন রাজ্যে এনআরসি কার্যকর করার মাধ্যমে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ‘বহিরাগত’হিসাবে ঘোষণার পর তাদেরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এনআরসি বা সিএএ যাই বলুন না কেন, মোদি সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে হিন্দু ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। যাতে করে আগামী লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচনগুলোতে বিজেপির ক্ষমতায় আসাটা নিশ্চিত হয়। আর ক্ষমতায় আসা কনফার্ম করতে গিয়ে মোস্তাকিন, নাজমুল, মালেক শেখ, আনোয়ার ও টগরী বিবির মতো অসংখ্য সাধারণ মানুষগুলো নাগরিকত্ব হারিয়ে দেশছাড়া হয় হউক, তাতে কার কি আসে যায়!

এমএ/

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/international/103311/মোস্তাকিনদের-দেশছাড়া-করে-ক্ষমতা-নিশ্চিত-করার-পাঁয়তারা-মোদির