রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৭)

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৭)

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -২৭)

যাহোক এদিন থেকেই মোটামুটি আমার বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে বিদায় নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে বিষয়টি মালিকপক্ষ, আমি এবং নঈম ছাড়া দু’একজন জানতে পারেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই সব কাজকর্ম করছি। অপেক্ষায় আছি শাহ আলম সাহেব কখন ডাকেন।

অন্যান্য

শাহজাহান সরদার

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -২৭)

যাহোক এদিন থেকেই মোটামুটি আমার বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে বিদায় নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে বিষয়টি মালিকপক্ষ, আমি এবং নঈম ছাড়া দু’একজন জানতে পারেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই সব কাজকর্ম করছি। অপেক্ষায় আছি শাহ আলম সাহেব কখন ডাকেন। ওদিক শামীম সাহেব ফোনের পর ফোন। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই শাহ আলম সাহেব ফোন করে তার অফিসে যেতে বললেন। আমি পদত্যাগপত্র ড্রয়ার থেকে বের করে নঈমকে নিয়ে যাই। গিয়ে দেখি শাহ আলম সাহেবের সামনে বসা বসুন্ধরা গ্র“পের এমডি সায়েম সোবহান (আনভীর) সাহেব এবং উপদেষ্টা তৈয়ব সাহেব। আমি আর নঈমও গিয়ে বসি। শাহ আলম সাহেব, জানতে চাইলেন, আপনার সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত। বললাম, হ্যাঁ। আনভীর সাহেব বলেন, আপনি কি পাগল। এতবড় পত্রিকা। নিজে কষ্ট করেছেন। আমরাও চেষ্টা করছি। অথচ এখন চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি তার কথার কোন জবাব দেইনি বা দিতে পারি না। কেননা তিনি অত্যন্ত সোজাসুজি কথা বলেন। কাজে-কর্মে খুবই গতিশীল। প্রতিদিনে কাজ করার সময় তিনি আমাকে যেমন শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন তেমনি সময়ে অসময়ে তাকেও আমি কাছে পেয়েছি। তিনি বললেন, চলে যাবেন, তবে যোগাযোগ রাখবেন। আমি পদত্যাগপত্রটি বের করে শাহ আলম সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। দুই কপি পদত্যাগপত্র। শাহ আলম সাহেব তৈয়ব সাহেবকে দিতে বললেন। বললাম, শাহ আলম ভাই, আপনি নিজে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে আমি খুশি হব। আমার মঙ্গল হবে। তিনি বললেন, আপনার মঙ্গল হবে কিন্তু আমার তো অমঙ্গল হতে পারে। অবশেষে তৈয়ব সাহেবই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এক কপি গ্রহণ করে তার স্বাক্ষরসহ আমাকে দিলেন। সেদিন ছিলো ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর। আর তখন থেকেই বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো। 

শাহ আলম সাহেব বললেন, আপনি এভাবে যাবেন না। বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হবে। আমিও থাকব। তৈয়ব সাহেবকে বললেন, দু’দিন পর সংবর্ধনার আয়োজন করতে। ইস্টওয়েস্ট মিডিয়ার অর্থাৎ কালের কণ্ঠ, সান, বাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলা নিউজ সকলকে সংবর্ধনার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বলেন। এ পর্যন্ত কথা শেষ করে আমি অফিসে গেলাম। নঈম একটু পরে এলো। এর মধ্যে অফিসে সব জানাজানি হয়ে গেছে। নঈম অফিসে ফিরে পর আমি কিছুক্ষণ অবস্থান করে উপস্থিত সবার সাথে কথা বলে প্রতিদিন থেকে বের হয়ে সোজা ল্যাবএইডে যাই। শামীম সাহেব অপেক্ষা করছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে অন্যদিনের চাইতে আগে বাসায় ফিরি। আমি সচরাচর ১১টার আগে বাসায় ফিরি না। এদিন তাড়াতাড়ি ফেরার কারণে স্ত্রী জানতে চায় শরীর অসুস্থ কি না? বললাম না, তার কাছে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি খুবই আশ্চর্য, মর্মাহত হলেন। বড় দু’ছেলে আমেরিকায়। ছোট ছেলেকে ডেকে আনলেন। জানালেন আমার কথা। বললেন, আবার পাগলামি? কারণ আমি যখন যুগান্তর ছেড়ে আসি তখন ছোট ছেলে নটরডেম কলেজে সবে ভর্তি হয়। দীর্ঘদিন বেকারত্বের কারণে তার লেখাপড়া এবং সংসারের ব্যয়ভার বহনে অনেক সমস্যা হয়েছিল। কষ্ট করতে হয় সবাইকে। আর এখন সে এমবিবিএস-এর ছাত্র। যদি ল্যাবএইডে কোন সমস্যা হয় তখন আবার সেই কষ্ট, দুর্ভোগ। 

বাংলাদেশ প্রতিদিনে থাকাকালে আমার স্ত্রী, ছোট ছেলে আর আমেরিকা থেকে আসা মেজো ছেলে এক অনুষ্ঠানের দিন অফিসে গিয়েছিলো। তখন বলেছিল কোন সময় চাকরিতে কোন সমস্যা হলে তাদের যেন বলি। হুট করে যেন না ছাড়ি। কিন্তু চাকরি ছাড়ার আগে কিছু না জানানোর কারণে দু’জনই ভীষণ ক্ষুব্ধ। আমি অসহায়ের মত। তারা কিছুতেই ল্যাবএইডকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। তাদের শান্ত করে একসঙ্গে নৈশভোজ সেরে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো না। পরদিন সকালে উঠে দেখি অনেক পত্রিকায় আমার পদত্যাগের খবর। মিড়িয়াপাড়ায় হৈ-চৈ। চারদিক থেকে ফোনের পর ফোন। কেন চলে আসছি? সমস্যা কী ছিল ইত্যাদি। আমি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি। মালিকদের সঙ্গে কোন সমস্যা ছিল না। এখনও নেই। যারা আমার সুহৃদ এদের কেউ বিষয়টি ভালভাবে নেননি। আমার মাথায় তখন নতুন চিন্তা। নতুন ধারণা। আরেকটি নতুন কাগজ বের করব। ভাল কাগজ। এমন ধারণা নিয়ে সকালেই ল্যাবএইডে গেলে শামীম সাহেবের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। তিনি নিয়ে গেলেন নতুন প্রস্তাবিত অফিসে। ছোটখাটো একটি রুম রেডি করা ছিল। আমাকে সেখানে বসানো হল।

২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে সংবর্ধনা। যথাসময়ে গেলাম। লিফটে উঠে সোজা আমার আগের রুমে গিয়ে পা দিলাম। একদিনের ব্যবধানে কিন্তু সেটি আমার রুম আর ছিল না। আমি তো পদত্যাগ করে আসছি। তাই গিয়ে দেখি অনেক বদল। নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজেকে অচেনা মনে হলো। আমি আমার আগের চেয়ারে না বসে সামনের একটি চেয়ারে বসলাম। অন্যরাও আমার সাথেই বসল। এখান থেকেই বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্মেলন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক কর্মচারী এবং ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়ার কয়েক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে কয়েকজন বক্তব্য দিলেন। ফুল ও উপহার দিয়ে বিদায় সংবর্ধনা জানালেন। এবার আমার পালা। আমি বক্তব্য রাখলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিন কীভাবে প্রকাশ হল, আমি কীভাবে সম্পৃক্ত হলাম সংক্ষেপে সেই কাহিনী বর্ণনা করলাম। অনেকেই এসব কাহিনী জানতেন না। জানার জন্যই বলা। অনেক সহকর্মীর চোখে সেদিন পানি দেখেছি। আমি তাদের বলেছি, আপনারা প্রতিষ্ঠিত কাগজে আছেন। বড় গ্র“পের কাগজ। আপনাদের কোন সমস্যা হবে না। আল্লাহ ভাল রাখবেন। আমি বরং অজানা গন্তব্যে পা দিয়েছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যত। আমার জন্য দোয়া করবেন। এই বলে গাড়িতে উঠে চলে আসি। উল্লেখ্য, যেদিন পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছিল সেদিনই আমি অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিই। সংবর্ধনার দিনে আমার ব্যক্তিগত গাড়িতেই গিয়েছিলাম। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। বসুন্ধরা থেকে আমাকে যে ড্রাইভার দেয়া হয়েছিল তিনি বেশ বয়স্ক। নাম আব্দুর রব। খুবই ভদ্র, বিনয়ী মানুষ। নিয়মিত নামাজ-রোজা করেন। অনেক বছর বসুন্ধরা গ্র“পের ড্রাইভার। তার কোন বিষয়ে লোভ-লালসা নেই। বিপদ-আপদ সব কিছুতেই শোকর করেছেন। আমি যখন পদত্যাগ করি তখন তিনি হজে ছিলেন। 

বসুন্ধরা গ্র“প থেকে প্রতি বছর শতাধিক লোককে হজে পাঠানো হয়। তার মধ্যে গ্র“পের গরিব কর্মচারীদেরও পাঠানো হয়। এজন্য গ্র“পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে নেয়া হয় তালিকা। আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে দু’জনের তালিকা দিয়েছিলাম। একজন প্র“ফ সেকশনের। তিনি প্রতিদিনের অফিসে নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। আরেকজন ড্রাইভার রব মিয়া। তিনি আগেই দরখাস্ত জমা দিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমাকে অনুরোধ করতে বলেন। আমি কর্তৃপক্ষকে জানালে তাকে পাঠানো হয়। রব মিয়া হজ থেকে এসে আমার পদত্যাগের কথা শুনে বাসায় দৌড়ে আসেন। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। আমার স্ত্রী বলেছে আমার জন্য আনা জায়নামাজ হাতে নিয়ে রব মিয়া শিশুর মতো কেঁদেছে। বারবার বলেছে, স্যার আমাকে হজে পাঠায় দিয়া চাকরি ছাইড়া দিছে। স্যার কাজটা ভাল করে নাই। আমি থাকলে পদত্যাগ করতে দিতাম না।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

আরএ

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/other/103600/রিপোর্টার-থেকে-সম্পাদক-(পর্ব--২৭)