টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের বেহাল দশা! বেকার হওয়ার আশংকা

টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের বেহাল দশা! বেকার হওয়ার আশংকা

বিশেষ প্রতিবেদক : ঈদের আগেই তাঁত শিল্পে ধস নামায় ঈদ পরবর্তী মন্দা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেছেন টাঙ্গাইলে তাঁতিরা। ঈদ ও পুজাকে কেন্দ্র করে তাঁত শিল্প সরগরম হওয়ার কথা থাকলেও লোকসানের হিসাব করে দিন কাটাচ্ছেন তাঁতিরা। বিক্রির আশায় হাটে কাপড় নিয়ে অলস সময় পার করছেন তাঁতিরা। তাদের ঘরে থেকে যাচ্ছে হাজার হাজার অবিক্রিত শাড়ী।

আবার যারা বিক্রি করেছেন তাদের চাহিদার তুলনায় তা নগন্য।

সরজমিনে জেলার কয়েকটি তাঁত শিল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তাঁতে কাপড় বুনানোর নেই সেই চির চেনা ব্যস্ততা। তাঁত মালিকরা শ্রমিকদের কাপড় বুনানোর জন্য কোন প্রকার তাগিদ দিচ্ছেন না। শ্রমিকরা তাদের নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী শাড়ী তৈরি করছেন। এমতবস্থায় ঈদের পর আবারো তার নিজ কর্মস্থল ফিরে পাবেন কিনা এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে সংশয়।
ঈদ মৌসুমে যেখানে শাড়ী বিক্রি করে রমরমা বাণিজ্য করে থাকেন তাঁত মালিকরা সেখানে ঈদ মৌসুমেও কেন শাড়ী ব্রিক্রি হচ্ছেনা এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় সদর উপজেলার করটিয়া হাটে বেশ কয়েকজন তাঁত মালিকের সাথে।

মমিনুর রহমান নামের এক তাঁত মালিক বলেন, সপ্তাহে আমার প্রায় ২ লাখ টাকা শ্রমিক মজুরি দিতে হয়। অথচ করটিয়ার হাটে শাড়ী বিক্রি করেছি মাত্র ২০ হাজার টাকার। শ্রমিক মজুরি দিতে বাকি টাকা আমাকে ধার করতে হবে। তাছাড়া কম মুল্যের নিু মানের ভারতীয় শাড়ী ও নানা রকমের পোষাক এদেশের মার্কেট গুলোতে সয়লাভ হওয়ায় দেশীয় তৈরি তাঁতের শাড়ী চরম ভাবে মার খাচ্ছে। দেশের ভেতর ভারতীয় শাড়ী বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতিমধ্যে ২০ থেকে ২৫ টি তাঁত বন্ধ করেছি আর অধিকাংশ তাঁত ঈদের পরে বন্ধ হবে।
করটিয়া হাট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাজাহান আনসারি জানান, গতবারের তুলনায় এবার শাড়ী বিক্রি কম। এবারের বন্যার কারনে তাঁতের শাড়ী কম চলছে। বন্যা কেটে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
আশরাফ আলী নামের এক ব্যবসায়ী জানান, বাঙ্গালি নারীরা তাদের বাঙ্গালি সংস্কৃতি ভুলে বিদেশি সংস্কৃতি বেছে নিয়েছে। যার ফলে আমাদের দেশে শাড়ী পরা নারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথচ আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে নারীদের কাছে শাড়ী পরাটাই হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতি। বাঙ্গালী নারীদের শাড়ীর ব্যবহার বাড়াতে সরকারকে টিভি ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসাহ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া হাতের তৈরি খটখটি তাঁতের পরিবর্তে পাওয়ারলোম তাঁতে শাড়ী উৎপাদন কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে যা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি।
মোসলেম উদ্দিন নামের এক তাঁত মালিক জানান, এক সময় বিদেশে রপ্তানি হতো টাঙ্গাইল শাড়ী। বর্তমান সরকার এতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারের আমলে সুতার দাম বারবার বৃ্িদ্ধ পেলেও দাম কমানোর কোন ব্যবস্থা নেই। সুতার দাম, দ্রব্য মুল্যের উর্ধ্বগতি, অতিরিক্ত শ্রমিক মজুরি ও হাটে শাড়ীর দামের সাথে কোন মিল না থাকায় বিপাকে পরতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের। যার ফলে ঈদের পর বেকার হয়ে পরবে হাজার হাজার শ্রমিক। ইতিমধ্যে আমার কয়েকটি তাঁত বিক্রি করে দিয়েছি।

কয়েকজন শ্রমিক জানান, তাঁতের শাড়ী আগের মতো চলছেনা। মহাজনরা আমাদের শ্রমিক মজুরি কমিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই দেশে কোন কাজ পাওয়া যায়না ঈদের পর তাঁত না চললে আমরা বেকার হয়ে পরবো। আমাদের কষ্টের সীমা থাকবেনা।

জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলায় তাঁত মালিক রয়েছেন মোট ১০ হাজার জন। আর তাদের ৬৪ হাজার ১২০টি তাঁত রয়েছে। তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন জেলার প্রায় দেড় লাখ মানুষ।

সারা বছর তেমন বেঁচাকেনা না হলেও ঈদ মৌসুমে সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে থাকেন তাঁত মালিকরা। এই সময়ে সুতার দোকানে সারা বছরের জমে থাকা কয়েক লক্ষ টাকার দেনা পরিশোধ করেন তাঁতিরা। আবার অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতাদের বাকিতে কাপড় বিক্রির টাকাও ফিরে পান এই সময়ে। অথচ এখনও পর্যন্ত বাকি টাকা ফিরে ও সুতার দোকানের বকেয়া টাকা পরিশোধ করেত পারেন নি তাঁতিরা। আর যারা ব্যাংক ও স্থানিয় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন তাদের মাথায় হাত। একদিকে সুদের টাকার ভার অন্য দিকে বাধ্যতা মুলক পরিশোধ করতে হবে শ্রমিক মজুরি। নানা মুখি চাপে দেউলিয়াত্বের পথে তারা।

তাঁত মালিকরা বলছেন, সরকারের কোন কর্মকর্তা তৃণমুল পর্যায়ে তাঁতিদের ব্যবসার কোন খোঁজ রাখেন না। আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা আমরা তাদের জানাতে পারিনা। মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান করা হলেও সরকারের ঘুম ভাঙ্গছেনা। অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না হলে তাঁত বন্ধ করে আমাদের রাস্তায় বসে পরা ছারা আর কোন উপায় থাকবেনা। হাজার হাজার নিরীহ শ্রমিক আর দেশের এতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে সরজমিনে এসে তৃণমুল তাঁতিদের সাথে কথা বলে সমস্যার সমাধান করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন সর্বস্তরের তাঁতিরা।