মেসির ‘পাপ’ আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা!

মেসির ‘পাপ’ আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা!

আকাশি-সাদায় ফিরে আসুক মেসির হাসি! ফাইল ছবিচারটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ লিগ লা লিগার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। লা লিগার সর্বোচ্চ গোলের জোগানদাতাও। চারবারের ফিফা বর্ষসেরা, যে মুকুট পরতে চলেছেন পঞ্চমবারের মতো। সব মিলে বার্সেলোনায় জেতা গুরুত্বপূর্ণ ট্রফির সংখ্যা ২৪টি! ইউরোপের শীর্ষ ফুটবলে খেলে ৫১৪ ম্যাচে ৪২৩ গোল!

এর সঙ্গে আরও তিনটি ট্রফি যোগ করুন: একটি বিশ্বকাপ, আর দুটি মহাদেশীয় শিরোপা। এবার বলুন, অবিসংবাদিতভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের নাম কী? লিওনেল মেসি! থামিয়ে দিতে চাইছেন তো? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—মেসি কবে বিশ্বকাপ জিতল! সঙ্গে দুটো মহাদেশীয় ট্রফিও!

না, জেতেননি। জিততে পারতেন। যদি ২০০৪ সালে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রস্তাবটায় সায় দিতেন সানন্দে। মেসি তত দিনে স্পেনের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। বার্সেলোনার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে লা লিগাও অভিষেক হয়ে গেছে। মেসিকে চায় স্পেন জাতীয় দল। ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব ২০ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ। মেসিকে স্পেনের যুবদলে রাখার প্রস্তাব দেওয়া হলো।

বয়স তখন তাঁর সতেরোও পূর্ণ হয়নি। এত কম বয়সে এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। মেসি জানেন, জীবনের সিংহভাগ সময় তাঁর কাটবে স্পেনেই। মাত্র ১৩ বছর বয়সে এখানে চলে এসেছেন। আর্জেন্টাইন স্প্যানিশের চেয়ে আসল স্প্যানিশ ভাষাটাই নাকি চোস্ত বলেন। আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত জানেন কিনা, এই সংশয় এখনো কাটেনি অনেকের।

সবচেয়ে বড় কথা, ফুটবলার হিসেবে তিনি আর্জেন্টিনায় জনপ্রিয় নন। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে আর্জেন্টিনার ফুটবল-পাগল মানুষদের কাছে কার্লোস তেভেজের অর্ধেকও নন মেসি। আর্জেন্টিনার মানুষদের মন জিততে হলে বোকা জুনিয়র্স কিংবা রিভার প্লেটের মতো ক্লাবের হয়ে খেলতে হয়। পরে ইউরোপে গিয়ে টাকা বানান, সমস্যা নেই। আগে আর্জেন্টিনার লিগে মন জিতুন ভক্তদের। মেসি তা করেননি, পেশাদার ফুটবল শুরুই হয়েছে তাঁর স্পেনে।

আর্জেন্টিনার মানুষদের মন জেতার আরেকটা পথ আছে। ভীষণ কঠিন এক পথ। মেসি সেই পথে হাঁটবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ফিরিয়ে দিলেন স্পেনের হয়ে খেলার প্রস্তাব। বেছে নিলেন আর্জেন্টিনাকেই। যেখানে নাড়িপোঁতা আছে তাঁর। সেই ছোট্টবেলাতেই শেকড় উপড়ে ভিনদেশে থিতু হওয়ার পরও কেন জন্মভূমি মানুষকে এভাবে টানে! কে জানে তার উত্তর!
এবং এইখানেই ‘ভুল’টা করলেন মেসি। এইখানেই ‘পাপ’ হলো তাঁর। স্পেনের হয়ে খেললে ২০০৮ থেকে ২০১২-এই চার বছরে দুটো ইউরো আর একটি বিশ্বকাপ জেতার কীর্তি যুক্ত হতো তাঁর নামের পাশে। এর সঙ্গে ক্লাবের হয়ে অবিশ্বাস্য অর্জন। পেলে নাকি ম্যারাডোনা-এই বিতর্কটা হতো সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার কে, তা নিয়ে। একটা সিদ্ধান্ত, শুধু একটা সিদ্ধান্তই পাল্টে দিল সব! মেসির বিশ্বকাপ জিততে না-পারার দায় কতটা তাঁর সামর্থ্যে, কতটা তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায়?

জ্যাক ক্যালিস বিশ্বকাপ জেতেননি। ক্রিকেট কোথায় তাঁর অবস্থান? শেষ বয়সে এসে বিশ্বকাপ জিতেছেন শচীন টেন্ডুলকার। যদি না জিততেন? সর্বকালের সেরা হতেন না? বিশ্বকাপ জিতেও, এত অবিশ্বাস্য রেকর্ড নিয়েও টেন্ডুলকার অনেকের চোখেই সর্বকালের সেরা নন। সর্বকালের সেরা মাপার কোনো আদর্শ কোনো মাপকাঠি নেই। সর্বকালের সেরা হতে গেলে বিশ্বকাপ জিততেই হয়—এই তত্ত্বে আপনি বিশ্বাস করতেই পারেন। কিন্তু ইকার ক্যাসিয়াসের মনে হয়েছিল, বিশ্বকাপ জেতার চেয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতাই কঠিন। এই কথাটাই সেদিন ইএসপিএনের টক শোতে বললেন লিভারপুলে ১৩ বছর​ খেলে যাওয়া, বর্তমানের ফুটবল পণ্ডিত স্টিভ নিকোল। জর্জ বেস্ট উত্তর আয়ারল্যান্ডে জন্মেছিলেন—দোষটা তাঁর?
ফুটবল ক্লাব-কেন্দ্রীক খেলা।

নিকোল মনে করেন, এখানে একজন খেলোয়াড়কে তাঁর ক্লাবের অর্জন দিয়েই মাপা উচিত। কিন্তু নিকোলের বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। দিজমা সান্তোস, নিলটন সান্তোস, জোজিমোদের কজন চেনে? অথচ এঁদের দুটো করে বিশ্বকাপ জেতার কীর্তি আছে। আবার এও তো সত্যি, এই বিশ্বকাপই পেলে-ম্যারাডোনাকে আলাদা করে দিয়েছে ক্রুইফ-​প্লাতিনিদের থেকে।

বিতর্ক চলছে। চলবে। তবে এই যুক্তির আয়না দিয়ে যদি দেখেন, আর্জেন্টিনাকে বেছে না নিলেই হয়তো ভালো করতে মেসি। অবশ্য এই তত্ত্বে সবচেয়ে বড় বিরোধিতা করবেন মেসি নিজেই। দেশ আর মাকে কেউ কখনো ভুলে থাকতে পারে! হোক না তিনি হাজার মাইল দূরে থাকেন। কোপা শেষে তো স্পেনে নয়, ফিরে গেছেন আর্জেন্টিনাতেই।
আর আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত? মেসি বলবেন, মুখ দিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে হয় কে বলেছেন? জাতীয় সংগীত গাইতে হয় হৃদয় দিয়ে!