শিক্ষার্থীদের আত্মহনন থামছেই না
শিক্ষার্থীদের আত্মহনন থামছেই না
দেশে হত্যার প্ররোচনা বা হত্যার সম্পৃক্ততা না থাকলে শুধু আত্মহত্য আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পায়।
বাংলাদেশ
আসিফ কাজলদেশে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ। বাদ যাচ্ছেন না মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। তবে এসব আত্মহত্যার ঘটনা থেমে থাকে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তেই।
বেসরকারি সংস্থা আচল জানায়, করোনাকালীন সময়ে ১৫ মাসে ১৫১ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এ তালিকায় ৪২ জন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী, ২৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছে।
শুধু পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী অপু আত্মহত্যা করেন। রাজধানীর চানখাঁরপুলের একটি মেস থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুভজ্যোতি মণ্ডলও তীব্র বিষন্নতা ও মানসিক চাপ সইতে না পেরে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
সর্বশেষ ঝিনাইদহে নিজ বাড়িতে চঞ্চল চক্রবর্তী নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। চঞ্চল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) রসায়ন বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত সোমবার (১৫ নভেম্বর) ঝিনাইদহের শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহসিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, চঞ্চল চক্রবর্তী তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন। ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তার আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।
এ ঘটনার দুদিন পার না হতেই গত বুধবার (১৭ নভেম্বর) খুলনার ফুলতলার খানজাহান আলী থানাধীন মাত্তমডাঙ্গা এলাকায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থী সুব্রত কুমার (২২) ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ বিষয়ে কুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানায়, ওইদিন প্রথম ক্লাস শেষ করে সকাল ১০টায় কুয়েট ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে দুপুর পৌনে ১২টায় যশোর থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয় সুব্রত। তার বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার ফলদা চারপাড়া গ্রামে। বাবার নাম চন্দন কুমার। কুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলো সুব্রত। ঘটনাটি নিশ্চিত করেন খানজাহান আলী থানার ওসি প্রবীর কুমার বিশ্বাস।
এর পরদিন বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) হাজী মুহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ১৭তম ব্যাচের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাধবী নামের এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে পেট্রোল পাম্প সংলগ্ন জয়ন্তী ছাত্রীনিবাস থেকে ওই শিক্ষার্থীর মরদেহ পাওয়া যায়।
সহপাঠীরা জানান, সেদিন দুপুর থেকেই মাধবীর রুম ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। প্রায় চার ঘণ্টা পর জানালা দিয়ে তার ঝুলন্ত দেহ দৃশ্যমান হলে ছাত্রীনিবাসের মালিক এসে দরজায় তালা আটকে দেয়। পরে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত মরদেহ নামিয়ে রাখে।
করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়াকে উদ্বেগজনক বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা। তারা এর কারণ হিসেবে বলছেন, করোনাকালে মানসিকভাবে ভেঙেপড়া, মাদক, আর্থিক সংকট, হতাশা, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, চাকরি নিয়ে হতাশাসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘মানুষ যখন আইসোলেশনে চলে যায়, অর্থাৎ নিঃসঙ্গতায় ভোগে, তখন আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এটি একটি সামাজিক কারণ।’
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রেমে ব্যর্থতা, দরিদ্র্য এগুলো হলো আত্মহত্যার আদি কারণ। কিন্তু এখন বুলিং, সাইবার বুলিং, পর্নোগ্রাফিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।’
অধ্যাপক জিয়াউর রহমান আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে অর্থনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন এখন অনেক বেড়েছে। কিন্তু পুলিশ, কোর্ট, প্রসিকিউশন ও প্রিজন আগের মতোই রয়ে গেছে। এই চারটি বিভাগের আমূল সংস্করণ ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না।’
পুলিশ আত্মহত্যার ঘটনাকে আমলে নেয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যার বাবার টাকা আছে এমন কেউ মারা গেলে সেটি পুলিশ একভাবে ডিল করে। কোন দরিদ্র শিক্ষার্থী আত্মহনন করলে তার ময়নাতদন্তও হয় না। এসব জায়গায় আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা কমানোর জন্য তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। সাংস্কৃতিক অ্যাক্টিভিটি, শরীরচর্চা করতে হবে। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বুদ হয়ে মোবাইল-কম্পিউটারের দিকে পড়ে আছে। এ জন্য স্কুল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। কমিউনিটিতে আলোচনা ও শিক্ষাক্রমে বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।
আত্মহত্যা মামলাগুলোর কি হয়
দেশে হত্যার প্ররোচনা বা হত্যার সম্পৃক্ততা না থাকলে শুধু আত্মহত্য আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পায়। আত্মহত্যার ঘটনায় যদি কোন হত্যার লক্ষণ না থাকে তবে সেক্ষেত্রে লাশের ময়নাতদন্ত না করেই মৃতদেহ পরিবারের হাতে হস্তান্তর করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত হলেও গ্রাম পর্যায়ে এ সংখ্যা একেবারেই নগন্য।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক বলেন, আত্মহত্যার ঘটনায় মৃতদেহের সুরতহাল ও প্রাথমিক তদন্ত আদালতে উথ্যাপন করে পুলিশ। তবে এ ঘটনাটি প্রাথমিক তদন্তের মধ্যেই আটকে থাকে। এর আর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন করা হয় না।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটনের পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) ফারুক হোসেইন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘একজন চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছে ‘প্রেমঘটিত’ বিষয়ে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে ‘আইসে’ আসক্ত হয়ে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের যে ৫০টি থানা আছে এর কোথাও যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এক্ষেত্রে আমরা লাশ উদ্ধার, ময়নাতদন্ত ও তার কারণ জানার চেষ্টা করি। আত্মহত্যার যদি কোনো কারণ না থাকে তবে অজ্ঞাত মৃত্যু হিসেবে মামলা নিয়ে থাকি। তবে কেন আত্মহত্যা হচ্ছে বা হয়েছে এ বিষয়ে আমরা কোন কাজ করি না।’
আত্মহত্যার ঘটনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এর দায়ভার এড়াতে পারে না। কারণ প্রতিকূল সময়ে শিক্ষার্থীদের ঠিকঠাক কাউন্সিলিং করা হচ্ছে না। এছাড়া সামাজিক নানা চাপ তো আছেই।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান জিন্নাতুল বোরাক বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘আমাদের ডিপার্টমেন্টে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কাউন্সিলিং সেবা দেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের কেউ যদি মানসিকভাবে মনে করেন কাউন্সিলিং প্রয়োজন তবে ডিপার্টমেন্ট থেকে এ বিষয়ে শতভাগ সহযোগিতা পাবেন।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. রাজিবুর রহমান বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদেরকে শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং যত্নবান হতে হবে। কোনভাবেই পরিবারের উচিত নয় অতিমারির এ সময় সন্তানের মন ও মানসিকতার উপর চাপ তৈরি করা। এছাড়াও শিক্ষার্থীদেরকে মাসে এক থেকে দু’বার কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের আনন্দের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষকদের আচরণ হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব।’
বাংলাদেশ জার্নাল/একে/ওয়াইএ
from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/bangladesh/182272/শিক্ষার্থীদের-আত্মহনন-থামছেই-না